সিরিল ব্রামি: ২০২৫ সালের ১৬ এপ্রিল ইউরোপীয় কমিশন প্রস্তাবিত একটি তালিকায় বাংলাদেশসহ আরো কয়েকটি দেশকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। প্রস্তাবটি বলছে, এই দেশগুলো থেকে যেসব মানুষ আশ্রয়ের আবেদন করছে, তাদের সাধারণত আশ্রয় পাওয়ার হার ৫% এর নিচে।বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করার পেছনে কয়েকটি যুক্তি দেওয়া হয়েছে—
(ক) দেশে কোনো যুদ্ধ বা ব্যাপক সহিংসতা নেই,
(খ) মানবাধিকার পরিস্থিতিতে ধীরে ধীরে অগ্রগতি হচ্ছে,
(গ) গণতান্ত্রিক সংস্কারের উদ্যোগ চলছে,
(ঘ) রাজনৈতিক শৃঙ্খলা মোটামুটি বজায় আছে।
কমিশনের মতে, যদিও কিছু গোষ্ঠী (যেমন এলজিবিটিকিউ, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, মানবাধিকার কর্মী) ঝুঁকিতে থাকতে পারে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ একটি নিরাপদ দেশ।
: ফ্রান্সে আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য এই ঘোষণার তাৎক্ষণিক প্রভাব কী হবে?
সিরিল ব্রামি: প্রাথমিকভাবে যেসব দেশ কমিশনের নিরাপদ তালিকায় রয়েছে তাদের নাগরিকদের আবেদন “ত্বরিত প্রক্রিয়া”—তে নেওয়া হবে।
ফ্রান্সে এর অর্থ হলো:
(ক) আবেদনকারীর সাক্ষাৎকার ও সিদ্ধান্ত খুব দ্রুত হয়ে যাবে (সাধারণত ১৫ দিনের মধ্যে)
(খ) আবেদন নাকচ হলে; আবেদনকারী স্বাভাবিকভাবে দেশে থেকে আপিল করতে পারবেন না
(গ) প্রিফেকচার আবেদন নাকচ হওয়ার পরপরই ফ্রান্স ত্যাগের নির্দেশ (ওকিউটিএফ) দিতে পারবে। ফলে অনেক আবেদনকারী পর্যাপ্ত আইনি সহায়তা না পেয়ে দেশে ফেরত পাঠানোর ঝুঁকিতে পড়তে পারেন।
: বাংলাদেশ বর্তমানে কী ফ্রান্সের নিজস্ব ‘নিরাপদ দেশ’ তালিকায় আছে?
সিরিল ব্রামি: না, বাংলাদেশ বর্তমানে ফ্রান্সের অফপ্রা (ফ্রান্সের শরণার্থী ও রাষ্ট্রহীন ব্যক্তি সুরক্ষা দপ্তর) কর্তৃক নির্ধারিত ‘নিরাপদ দেশ’ তালিকায় নেই। এটি একসময় ছিল কিন্তু ২০১৩ সালে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক আদালত (কনসাই দ্যু এ্যাতা) এক রায়ে সেটি বাদ হয়ে যায়।
অতএব, এখন পর্যন্ত ফরাসি আইনে বাংলাদেশকে ‘নিরাপদ দেশ’ বলে বিবেচনা করা হয় না। তবে ইউরোপীয় তালিকা চূড়ান্ত হলে এবং আইন কার্যকর হলে ফ্রান্স সেই তালিকা অনুসরণ করতে বাধ্য হবে—এটা ফরাসি সংবিধানের ৮৮-১ ধারার অধীনে ইউরোপীয় আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের অংশ।
: এই ঘোষণার বিরুদ্ধে আইনি চ্যালেঞ্জ করার কোনো সুযোগ থাকবে কি?
সিরিল ব্রামি: হ্যাঁ, অবশ্যই। যেকোনো আবেদনকারী তার ব্যক্তিগত প্রেক্ষাপটে প্রমাণ করতে পারবেন যে, তার জন্য দেশটি নিরাপদ নয়। এটি একটি ব্যক্তিগত মূল্যায়ন প্রক্রিয়া হবে, যেখানে আবেদনকারী দেখাতে পারবেন তিনি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন অথবা গুরুতর ঝুঁকিতে আছেন।
বিশেষ করে যদি কেউ এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ভুক্ত, সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বী, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী বা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের কর্মী তাহলে তার মামলাটি গভীরভাবে মূল্যায়ন করা হবে।
: তাহলে কি বাংলাদেশি আশ্রয়প্রার্থীদের আশ্রয় পাওয়া পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে?
সিরিল ব্রামি: একেবারেই না। এটি ভুল বোঝাবুঝি। ‘নিরাপদ উৎস দেশ’ বলে ঘোষণার অর্থ এই নয় যে, বাংলাদেশের সব আবেদনকারী স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রত্যাখ্যাত হবেন। বরং, এই প্রক্রিয়ায় আবেদন পরীক্ষা হবে দ্রুততর ও কঠোর মানদণ্ডে।
যরা বাস্তবে নিপীড়নের শিকার, তাঁদের অবশ্যই সব প্রমাণ, তথ্য ও আইনি সহযোগিতা নিয়ে আবেদন করতে হবে। সঠিক প্রস্তুতি থাকলে এখনো আশ্রয় পাওয়ার সুযোগ রয়েছে।
:বাংলাদেশি কমিউনিটির জন্য আপনার পরামর্শ কী?
সিরিল ব্রামি: প্রথমত; আতঙ্কিত না হয়ে তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ইউরোপীয় আইনের কাঠামো এখনো আবেদনকারীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা বিবেচনায় নেয়। দ্বিতীয়ত; এখন আরো প্রয়োজন বিশ্বস্ত ও দক্ষ আইনি সহায়তা যাতে প্রতিটি আবেদন যথাযথভাবে উপস্থাপন করা যায়।
তৃতীয়ত; যারা ঝুঁকিতে আছেন বিশেষ করে নারী, এলজিবিটিআই ব্যক্তিরা, সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বীরা তাদের অবশ্যই বিশেষ তথ্যসহ আবেদন করতে হবে, যাতে আশ্রয় মঞ্জুরের যৌক্তিকতা স্পষ্ট হয়।
সর্বোপরি, রাজনৈতিক ও মানবিক বাস্তবতা বোঝা, ফরাসি আইনি কাঠামো জানা, এবং আইনি অধিকার চর্চা করার ক্ষমতা—এগুলোই এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি।