শত বছরের পুরোনো এক বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তির আওতায় বেলজিয়াম থেকে ভারতের হীরা ব্যবসায়ী মেহুল চোকসিকে ফেরত আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে ভারত। ১৯০১ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে স্বাক্ষরিত চুক্তিটি এখনো বলবৎ রয়েছে বলে জানিয়েছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
এই ঘটনা নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে—ব্রিটিশ আমলের এমন চুক্তি যদি ভারত ব্যবহার করতে পারে, তবে বাংলাদেশ কেন পারছে না?বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্রিটিশ ভারতে করা চুক্তিগুলোর বেশিরভাগই ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীনতার পর অনুমোদন করে নেয়। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানের করা কোনো চুক্তিকেই আইনি স্বীকৃতি দেয়নি।ফলে ব্রিটিশ আমলের কোনো প্রত্যর্পণ চুক্তি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।বাংলাদেশের নিজস্ব ‘বন্দি প্রত্যর্পণ আইন, ১৯৭৪’ অনুযায়ী, কোনো অপরাধীকে ফেরত আনার জন্য সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে আলাদাভাবে চুক্তি করতে হয়। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ মাত্র দুটি দেশের সঙ্গে প্রত্যর্পণ চুক্তি করেছে—ভারত ও থাইল্যান্ড।ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ‘প্রত্যর্পণ-যোগ্য অপরাধের মামলা’য় অভিযুক্ত বা পলাতক আসামি বা সেদেশের কারাগারে থাকা বন্দিদের একে অপরের কাছে হস্তান্তরের জন্য ২০১৩ সালে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়।এই চুক্তির একটি ধারায় বলা হয়েছে, যার হস্তান্তরের জন্য অনুরোধ জানানো হচ্ছে তার বিরুদ্ধে অভিযোগটা যদি ‘রাজনৈতিক প্রকৃতির’ হয় তাহলে সেই অনুরোধ খারিজ করা যাবে।বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার একাধিকবার জানিয়েছে, তারা ভারতে আশ্রয় নেয়া ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফেরত চেয়েছে। কিন্তু চুক্তি থাকার পরেও তাকে ফেরাতে পারেনি বাংলাদেশ।কোন কোন অপরাধের অভিযোগকে ‘রাজনৈতিক’ বলা যাবে না, সেই তালিকাও বেশ লম্বা।এর মধ্যে হত্যা, গুম, অনিচ্ছাকৃত হত্যা ঘটানো, বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো ও সন্ত্রাসবাদের মতো নানা অপরাধ আছে। এই চুক্তি ২০১৬ সালে সংশোধন করে এমন একটি ধারা যুক্ত করা হয় যাতে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া আরো সহজ হয়।
সংশোধিত এই ধারায় বলা হয়েছে, কোনো অভিযুক্তের হস্তান্তর চাওয়ার সময় অনুরোধকারী দেশকে সেই সব অভিযোগের পক্ষে কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ পেশ না করলেও চলবে। শুধু সংশ্লিষ্ট আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পেশ করলেই সেটিকে বৈধ অনুরোধ হিসেবে ধরা হবে।তবে, প্রত্যর্পণযোগ্য ব্যক্তির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অভিযোগের প্রেক্ষাপটে চুক্তিভুক্ত রাষ্ট্র সেই অনুরোধ খারিজ করে দিতে পারে, চুক্তির এমন বিধানের কারণে জটিলতা তৈরি হয়।ভারতে আশ্রয় নেওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফেরত আনার চেষ্টা এমন জটিলতার একটি উদাহরণ, যেখানে চুক্তি থাকলেও প্রত্যর্পণ সম্ভব হয়নি।আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ কাজী ওমর ফয়সাল বলেন, শুধু আইন থাকলেই হবে না, কূটনৈতিক প্রচেষ্টা আরো বেশি জরুরি। অনেক সময় আইন না থাকলেও কূটনৈতিকভাবে বিষয়টি সমাধান করা সম্ভব হয়।তিনি আরো জানান, ভারত-বাংলাদেশ চুক্তিতে বিরোধ নিষ্পত্তির কোনো ব্যবস্থা নেই, ফলে দ্বিপক্ষীয় মতানৈক্য হলে সেটি রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে হয়।ভারত ছাড়াও ২০০৯ সালে থাইল্যান্ডের সঙ্গে বাংলাদেশ প্রত্যর্পণ চুক্তিটি করে। এছাড়া বিভিন্ন সময় দেখা গেছে আরো বেশ কয়েকটি দেশ যেমন কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য থেকে বিভিন্ন সময়ে অপরাধীদের ফেরাতে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়েছে সরকার। তবে বাংলাদেশের এসব দেশের সঙ্গে কোনো প্রত্যর্পণ চুক্তি নেই বলে জানা গেছে। এর মধ্যে যুক্তরাজ্য ‘ইউরোপীয়ান কনভেনশন অব হিউম্যান রাইটস’ এর সদস্য। এই কনভেনশনের সদস্য দেশগুলো অপরাধের দণ্ড হিসেবে মৃত্যুদণ্ড ইতিমধ্যেই বিলোপ করেছে। ফলে যেসব দেশে এই বিধান রয়েছে সেখানে তারা কোনো ব্যক্তিকে ফেরত পাঠায় না। ফলে সেখান থেকে দণ্ডিত বা অভিযুক্ত পলাতক আসামিদের ফেরাতে হলে বাংলাদেশকে মৃত্যুদণ্ডের বিধান নেই এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।কানাডার সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী, যে দেশে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে সে দেশে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ফেরত পাঠানো যাবে না।সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিম জানান, শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলার এক আসামিকে এই কারণে কানাডা থেকে ফেরত আনা সম্ভব হয়নি। যেহেতু তারা নিজেদের আইনে ফাঁসির বিধান বন্ধ করে দিয়েছে। সুতরাং তারা যেসব দেশে এই বিধান রয়েছে সেখানে ওই নাগরিককে হস্তান্তর করে না।
বর্তমানে বাংলাদেশ কাতার ও মালদ্বীপের সঙ্গে প্রত্যর্পণ চুক্তি স্বাক্ষরের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। উপদেষ্টা পরিষদ ইতোমধ্যে খসড়া চুক্তি নীতিগতভাবে অনুমোদন দিয়েছে।
এ ক্যাটাগরির আরো নিউজ..