আমাদের শরীরের কোনো অংশ আগুনে পুড়ে গেলে শরীরে ক্ষত সৃষ্টির পাশাপাশি মনেও গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়। চোখের পলকে ঝলসে যাওয়া ত্বক আর অসহ্য যন্ত্রণা জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলতে পারে। সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করতে পারলে এবং সঠিক চিকিৎসা নিতে পারলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ যেমন কমানো সম্ভব তেমনি পোড়া রোগীরাও ফিরে পেতে পারেন স্বাভাবিক জীবন। বিস্তারিত লিখেছেন কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের (উত্তরা, ঢাকা) কনসালট্যান্ট ও বিভাগীয় প্রধান (সার্জারি) ডা. মো. নাহিদ সিকদার
আগুনে পোড়া রোগীকে তাপের উৎস থেকে দ্রুত দূরে সরিয়ে নিতে হবে। চিৎকার করে আশপাশের লোকজনের সাহায্য চাইতে হবে। গায়ে লেগে থাকা আগুন নেভাতে হবে। গায়ে আগুন নিয়ে দৌড় দেবেন না। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে শুয়ে গড়াগড়ি করুন। পানি দিয়ে জ্বলন্ত আগুনের শিখা নিভিয়ে ফেলুন। ভারী কম্বল থাকলে/মোটা চটের বস্তা থাকলে তা দিয়ে পেঁচিয়ে নিন। কাপড়ে আগুন লেগে গেলে তা সঙ্গে সঙ্গে খুলে ফেলুন। আগুন লেগেছে এমন কোনো বদ্ধ জায়গায় আটকা পড়ে থাকলে দ্রুত খোলামেলা জায়গায় চলে আসার চেষ্টা করুন।
* আগুনে পোড়া রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসা
▶ প্রচুর পানি ঢালুন : আক্রান্ত স্থান ঠান্ডা করার জন্য প্রবহমান টেপের পানি/বালতি/মগ ব্যবহার করে কমপক্ষে ২০ মিনিট থেকে সর্বোচ্চ ১ ঘণ্টা পর্যন্ত স্বাভাবিক তাপমাত্রার অথবা হালকা ঠান্ডা পানি ঢালতে থাকুন। বরফ বা বরফ ঠান্ডা পানি ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন। এতে হাইপোথার্মিয়া হয়ে আক্রান্ত ব্যক্তির আরও বেশি ক্ষতি হতে পারে।
▶ কাপড় ও গয়না খুলে ফেলুন : পুড়ে যাওয়া বা আগুন লেগে যাওয়া কাপড় এবং শরীরের গয়না বা অলংকারাদি খুলে ফেলুন। যেমন-হাতের চুড়ি পরা অবস্থায় পোড়া হাত ফুলে গিয়ে হাতের রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে আরও বেশি ক্ষতি সাধন হতে পারেন।
▶ ক্ষতস্থান ঢেকে রাখুন : পরিষ্কার জীবাণুমুক্ত গজ/পরিষ্কার কাপড় দিয়ে ক্ষতস্থান ঢেকে রাখতে হবে।
▶ শরীর কাপড় দিয়ে মুড়ে দিন : আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর কাপড়/মোটা কম্বল দিয়ে মুড়িয়ে রাখলে শরীরের সঠিক তাপমাত্রা বজায় থাকবে। শরীরে কোনোভাবে চাপ বা ঘষা যেন না লাগে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
▶ আক্রান্ত ব্যক্তিকে বসিয়ে রাখুন : বিশেষ করে মুখমণ্ডল বা গলা পুড়ে যাওয়া রোগীকে বসিয়ে রাখার চেষ্টা করুন। এতে শ্বাসনালি ফুলে গিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা কমে যাবে।
▶ আক্রান্ত স্থান উঁচু করে রাখার চেষ্টা করুন : বিশেষভাবে হাত-পা উপরে তুলে রাখতে পারলে ফুলা ভাব কিছুটা কম হবে এবং এতে ক্ষতির আশঙ্কাও কমবে।
▶ ব্যথানাশক ওষুধ সেবন : যেমন-প্যারাসিটামল/আবুপ্রোফেন সেবন করা যেতে পারে।
▶ মলম ব্যবহার : সিলভার সালফাডায়াজিন ১% মলম (যেমন বার্ণা বা সিলক্রিম) আক্রান্ত স্থানে ব্যবহার করা যেতে পারে।
* অন্যান্য পোড়া রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসা
▶ অ্যাসিড বা এলকালি দিয়ে পোড়া : অ্যাসিড জাতীয় রাসায়নিকে পোড়া রোগীর ক্ষেত্রে দ্রুত রাসায়নিকে ভেজা কাপড় খুলে ফেলতে হবে। হাসপাতালে যাওয়ার আগ পর্যন্ত প্রচুর পরিমাণ পরিষ্কার পানি দিয়ে ক্ষতস্থানটি ধুতে হবে।
▶ ইলেকট্রিক শক/বৈদ্যুতিক পোড়া : মনে রাখবেন, সব ধরনের বৈদ্যুতিক পোড়া গভীর বা ডিপ বার্ন হিসাবে পরিচিত। এতে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই বাইরে থেকে রোগীর খুব বেশি পোড়া দাগ না থাকলেও দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
আগুন বা অন্যান্য কারণে পোড়া রোগীকে পর্যাপ্ত পরিমাণ তরল খাবার পান করাতে হবে। এক্ষেত্রে যেসব রোগী খেতে পারে তাকে পানি, ডাবের পানি, স্যালাইনের পানি, লেবুর শরবত ইত্যাদি তরল জাতীয় খাবার দেওয়া যেতে পারে। যতটুকু সম্ভব প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে আক্রান্ত ব্যক্তিকে যতদ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শের জন্য হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
* পোড়া রোগীর ধরন
পোড়া রোগীকে ‘পোড়া চামড়ার পুরুত্বের’ ওপর ভিত্তি করে সাধারণত ২ ভাগে ভাগ করা যেতে পারে।
▶ Superficial Burn বা পাতলা পোড়া ক্ষত : এতে প্রচণ্ড ব্যথা থাকে। পোড়া জায়গায় চাপ দিলে লাল চামড়া সাদা হয়ে যাবে এবং ছেড়ে দিলে আবার লাল হবে। এটা তুলনামূলক ভালো এবং রোগীর দ্রুত সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
▶ Deep Burn বা গভীর পোড়া ক্ষত : এতে রোগীর কোনো ব্যথা থাকে না। চাপ দিলে চামড়া লাল বা সাদা কিছুই হয় না। যেমন চামড়া তেমনই থাকে। এটা খুবই খারাপ পোড়া। রোগীর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির আশঙ্কা এতে অনেক বেশি।
* শরীরের শতকরা কতভাগ পুড়েছে তার হিসাব
পোড়া রোগীর ক্ষেত্রে সারা শরীরকে ১০০ শতাংশ ধরা হয়। এর কত শতাংশ পুড়েছে এটা ‘Rule of 9’ এর মাধ্যমে হিসাব করা হয়ে থাকে। যেমন, মাথা-মুখমণ্ডল-গলা ৯ শতাংশ, বুকের সামনের অংশ ৯ শতাংশ, বুকের পেছনের অংশ মানে উপরের পিঠ ৯ শতাংশ, পেটের সামনের অংশ ৯ শতাংশ, পেটের পিছনের অংশ মানে নিচের পেট ৯ শতাংশ, পুরো ডান হাত এবং বাহু ৯ শতাংশ, পুরো বাম হাত এবং বাহু ৯ শতাংশ, পুরো ডান পা এবং উরুর সামনের অংশ ৯ শতাংশ, পুরো ডান পা এবং উরুর পেছনের অংশ ৯ শতাংশ, পুরো বাম পা এবং উরুর সামনের অংশ ৯ শতাংশ, পুরো বাম পা এবং উরুর পেছনের অংশ ৯ শতাংশ, পেরিনিয়াম বা মলদ্বার এবং মূত্রনালির মাঝের অংশ ১ শতাংশ মিলে মোট ১০০ শতাংশ।
* সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু
পোড়া রোগীর সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা নিম্নের বিষয়গুলোর উপর নির্ভর করে, অর্থাৎ- পোড়া চামড়ার শতকরা অংশ, পোড়া চামড়ার পুরুত্ব, শ্বাসনালি পুড়েছে কিনা ও রোগীর বয়স এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য রোগ।
* কোন ধরনের রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে
▶ শ্বাসনালি/মুখমণ্ডল পোড়া রোগী।
▶ শিরায় স্যালাইন দিতে হবে এমন রোগী (বড়দের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ১৫ শতাংশ এবং বাচ্চাদের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ পোড়া ক্ষত)।
▶ এমন পোড়াক্ষত যার অপারেশন লাগবে।
▶ পোড়াক্ষত-হাত, পা, মুখমণ্ডল, পেরিনিয়াম।
▶ মানসিকভাবে অসুস্থ পোড়া রোগী।
▶ এমন পোড়া রোগী যা দুর্ঘটনাজনিত কারণে ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে না, যেমন-আত্মহত্যাজনিত কারণ।
▶ বাচ্চা বা বৃদ্ধ পোড়া রোগী।
▶ বৈদ্যুতিক শক বা অ্যাসিড/এলকালিজনিত রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে পোড়া রোগী।
* কোন ধরনের পোড়া রোগীর অপারেশন লাগে
▶ গভীর পুরুত্বের পোড়া রোগী।
▶ কম পুরুত্বের পোড়া রোগী কিন্তু ২-৩ সপ্তাহে ভালো হচ্ছে না।
▶ বিশেষ অঙ্গ পুড়ে গেলে যেমন-হাতের তালু, পায়ের পাতা, মুখমণ্ডল।
▶ পোড়া রোগীর জটিলতা তৈরি হলে, যেমন-ইনফেকশন, কনট্রাকচার।
▶ সারকামফেরেনশিয়াল বার্ন বা চারপাশের পোড়া যেমন-বাহুর চারপাশ, পা বা উরুর চারপাশ, বুকের চারপাশ পুড়ে গেলে জরুরি অপারেশন প্রয়োজন হয়।
* অগ্নিকাণ্ড এবং পোড়া প্রতিরোধের উপায়
আগুনে পোড়া রোগীর ক্ষেত্রে মৃত্যুঝুঁকি বেশি থাকে। যদি শরীরের বেশিরভাগ অংশ পুড়ে যায় তাহলে ঝুঁকির পরিমান অনেক বেশি। সম্ভাব্য বিপদ এড়াতে আগুন যাতে না লাগে সেজন্য সতর্ক থাকা জরুরি। প্রথমত, বাড়ির বৈদ্যুতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য বৈদ্যুতিক তার ও সরঞ্জাম নিয়মিত পরীক্ষা করুন। অতিরিক্ত বৈদ্যুতিক লোড পরিহার করুন। পুরোনো বা ত্রুটিপূর্ণ তার বা সরঞ্জাম ব্যবহার পরিহার করুন। দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে গ্যাস নিরাপত্তা। এজন্য রান্নার পর গ্যাস সম্পূর্ণভাবে বন্ধ রাখুন। লিক হলে দ্রুত সারাবার ব্যবস্থা করুন। গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারে সতর্ক হোন। অন্যান্য কারণেও আগুন লাগতে পারে। এজন্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। যেমন-দিয়াশলাই, লাইটার, মোমবাতি ইত্যাদি শিশুদের নাগালের বাইরে রাখুন। বৈদ্যুতিক সুইচ থেকে শিশুদের সাবধানে রাখুন। পেট্রোল, অকটেন, গ্যাসলাইন, স্প্রেক্যান ইত্যাদি দাহ্য পদার্থ নিরাপদ স্থানে রাখুন। রান্না ঘরে চুলার আশপাশে দাহ্য বস্তু রাখবেন না। জনবসতিপূর্ণ এলাকায় রাসায়নিক পদার্থের গোডাউন/ফাক্টরি করা থেকে বিরত থাকুন। আগুন লাগলে সেটা নেভাতে অগ্নি নির্বাপন সরঞ্জাম প্রয়োজন হয়। এজন্য অগ্নি নির্বাপন যন্ত্র (ফায়ার এক্সটিংগুইশার) হাতের কাছে রাখুন এবং কীভাবে ব্যবহার করতে হয় তা নিজে জানুন এবং অন্যকে জানান।
* জরুরি অবস্থা মোকাবিলায় যা করবেন
জরুরি অবস্থা মোকাবিলায় ফায়ার সার্ভিসের সাহায্যের জন্য জরুরি নম্বর বিভিন্ন জায়গায় প্রদর্শন করুন। বাড়ি বা স্থাপনা তৈরির সময় জরুরি বহির্গমন পথ রাখুন। প্রশস্ত রাস্তা রাখুন যাতে সহজেই ফায়ার সার্ভিসের লোকজন এসে তাদের কাজ করতে পারেন। যে কোনো দুর্ঘটনাকবলিত জায়গায় অতি উৎসাহী হয়ে ভিড় তৈরি করবেন না। অগ্নি নিরাপত্তা বিষয়ক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করুন। অগ্নিকাণ্ডের কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কে সচেনতা বৃদ্ধি করুন এবং সচেতনতামূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করুন।
যার যার উপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের মাধ্যমে এবং যথেষ্ট সতর্কতা ও সচেতনতার মাধ্যমে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি এবং সেইসঙ্গে আগুনে পোড়া রোগীর সংখ্যা অনেকাংশে কমানো সম্ভব।