সংজ্ঞা : পশ্চিমা গণতন্ত্র হলো এমন একটি শাসনব্যবস্থা, যেখানে জনগণই রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার উৎস, এবং সরকার গঠিত হয় জনগণের ইচ্ছা ও নির্বাচনের মাধ্যমে; এখানে ধর্ম এবং রাষ্ট্রের মধ্যে স্পষ্ট পৃথকীকরণ থাকে এবং ব্যক্তি স্বাধীনতা, মানবাধিকার ও আইনের শাসন মৌলিক ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। সংক্ষেপে ‘জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য, জনগণের শাসনব্যবস্থা’— এভাবেই পশ্চিমা গণতন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করা হয় (উদাহরণ— আব্রাহাম লিঙ্কনের বিখ্যাত উক্তি)।
ব্যাখ্যা : পশ্চিমা গণতন্ত্রের ভিত্তি মূলত ইউরোপের রেনেসাঁ, প্রাগৈতিহাসিক গ্রিক গণতন্ত্রের ধারণা এবং ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও আমেরিকায় ঘটিত রাজনৈতিক বিপ্লবের ওপর দাঁড়িয়ে গড়ে উঠেছে। এখানে মানুষকেই শাসক হিসেবে চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী মনে করা হয়।
পশ্চিমা গণতন্ত্রের মূল বৈশিষ্ট্য : ১. জনগণের সার্বভৌমত্ব : জনগণই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের উৎস। ২. সংখ্যাগরিষ্ঠতার শাসন : নীতিনির্ধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে হয়। ৩. ধর্ম ও রাষ্ট্রের পৃথকীকরণ : রাষ্ট্রীয় নীতিতে ধর্মের কোনো আনুষ্ঠানিক ভূমিকা থাকে না। ৪. আইনের শাসন : প্রত্যেক নাগরিক আইনের চোখে সমান, রাষ্ট্রের শাসকও আইনের ঊর্ধ্বে নয়। ৫. ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মানবাধিকার : মতপ্রকাশ, ধর্মাচরণ, সমাবেশ ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণের স্বাধীনতা নিশ্চিত। ৬. নির্বাচন : নিয়মিত, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হয়। ৭. ক্ষমতার ভারসাম্য : শাসন ব্যবস্থায় নির্বাহী, আইন প্রণয়ন ও বিচার বিভাগ আলাদা এবং একে অপরকে নিয়ন্ত্রণ করে।
পশ্চিমা গণতন্ত্রের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক : গ্রীসের এথেন্সের সরাসরি গণতন্ত্র (খ্রিষ্টপূর্ব ৫ম শতাব্দী)। ম্যাগনা কার্টা (১২১৫ খ্রি.), যেখানে রাজাকে আইনের অধীনে আনতে বাধ্য করা হয়। ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯ খ্রি.), যেখানে ‘স্বাধীনতা, সমতা ও ভ্রাতৃত্ব’ স্লোগান জনপ্রিয় হয়। আমেরিকান সংবিধান (১৭৮৭ খ্রি.), যেখানে প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপিত হয়।
বাস্তবচিত্র : বর্তমান পশ্চিমা বিশ্বে (যেমন : যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি) গণতন্ত্রের মডেল অনুসরণ করে রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। যদিও আদর্শভাবে সবাই সমান, বাস্তবে নানা শ্রেণিভেদ, করপোরেট লবিং এবং গণমাধ্যমের প্রভাব পশ্চিমা গণতন্ত্রের চর্চাকে প্রশ্নবিদ্ধও করে।
সংক্ষেপে বলা যায়, পশ্চিমা গণতন্ত্র হলো এমন একটি শাসনব্যবস্থা যেখানে ধর্মীয় বিধানের প্রভাবহীন জনগণের ইচ্ছাকে শাসনব্যবস্থার একমাত্র বৈধ উৎস হিসেবে গণ্য করা হয় এবং যেখানে ব্যক্তি স্বাধীনতা ও সংখ্যাগরিষ্ঠতার সিদ্ধান্তই সর্বোচ্চ নীতিরূপে প্রতিষ্ঠিত থাকে।
ইসলামি গণতন্ত্রের সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা
ইসলামি গণতন্ত্র হলো এমন একটি শাসনব্যবস্থা, যেখানে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের অধীনে কোরআন ও সুন্নাহর নির্দেশনা অনুসারে জনগণের পরামর্শ (শূরা) এবং অংশগ্রহণের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। এতে শাসকের জবাবদিহিতা, ন্যায়বিচার, মানবাধিকারের সুরক্ষা এবং ধর্মীয় নীতিমালার প্রতি আনুগত্য আবশ্যিক। সংক্ষেপে : ‘আল্লাহর আইন ও সীমার মধ্যে জনগণের পরামর্শভিত্তিক শাসনব্যবস্থা’— এটিই ইসলামি গণতন্ত্রের মূল ধারণা।
ব্যাখ্যা : ইসলামে শাসনব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য হলো ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা, অন্যায়ের প্রতিরোধ এবং সমাজে শান্তি ও কল্যাণ নিশ্চিত করা। ইসলাম শাসকের ওপর জনগণের অধিকার রক্ষা ও জনগণের পরামর্শ অনুযায়ী নীতিনির্ধারণের দায়িত্ব আরোপ করেছে। কোরআনে আল্লাহ বলেন : ‘তাদের কাজ পরস্পরের পরামর্শের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়’। (সূরা আশ-শূরা, ৪২:৩৮)। এ থেকে বোঝা যায়, নেতৃত্ব নির্ধারণ এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের মতামত ও অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ। তবে এ অংশগ্রহণ আল্লাহর বিধান ও শরিয়াহর সীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ। এখানে মানুষের ইচ্ছা স্বাধীন নয়; বরং তা আল্লাহর বিধানের অধীন।
ইসলামি গণতন্ত্রের মূল বৈশিষ্ট্য : ১. আল্লাহর সার্বভৌমত্ব : চূড়ান্ত কর্তৃত্ব আল্লাহর। ২. শূরা বা পরামর্শ : নেতৃত্ব ও সিদ্ধান্ত পরামর্শের ভিত্তিতে গৃহীত হয়। ৩. ন্যায়বিচার ও সাম্য : সবার জন্য সমান ন্যায়বিচার নিশ্চিত। ৪. শাসকের জবাবদিহিতা : নেতা জনগণের নিকট এবং আল্লাহর কাছে দায়বদ্ধ। ৫. আইনের শাসন : শরিয়াহর ভিত্তিতে আইন প্রয়োগ হয়। ৬. নৈতিকতা ও তাকওয়া : নেতৃত্বের যোগ্যতার অন্যতম শর্ত আল্লাহভীতি ও নৈতিকতা। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যুগের বাস্তব উদাহরণ : মদীনা সনদ, শূরা ভিত্তিক রাষ্ট্র পরিচালনা এবং সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে খলিফা নির্বাচনের প্রক্রিয়া (যেমন : আবু বকর (রা.)-এর বাই’আ) ইসলামি গণতন্ত্রের উজ্জ্বল নিদর্শন।
মৌলিক পার্থক্যগুলো
১. সার্বভৌমত্বের ভিত্তি। ইসলামিক গণতন্ত্র : আল্লাহ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। মানবজাতি তার বিধান পালনে বাধ্য। উদাহরণ : কোরআন বলে ‘শাসন ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর’ (সূরা ইউসুফ, ১২:৪০)। পশ্চিমা গণতন্ত্র : মানুষই শাসনের মূল উৎস। জনগণের ইচ্ছাই সর্বোচ্চ আইন। উদাহরণ : ফরাসি বিপ্লবের মূলমন্ত্র ছিল ‘জনগণের শাসন, জনগণের জন্য।’
২. আইন প্রণয়ন ও পরিবর্তন। ইসলামিক গণতন্ত্র : কোরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক অপরিবর্তনীয় মূলনীতি রয়েছে। মানুষের ইচ্ছার দ্বারা শরিয়াহর সীমা লঙ্ঘন করা চলবে না। উদাহরণ : কেউ যদি শরিয়াহর কোনো মৌলিক হুকুম পরিবর্তন করে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। পশ্চিমা গণতন্ত্র : আইন জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী পরিবর্তিত হতে পারে। সময়ের প্রয়োজন ও সংখ্যাগরিষ্ঠতার ইচ্ছা অনুযায়ী সংবিধান বা আইন সংশোধন সম্ভব।
৩. ধর্ম ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক : ইসলামিক গণতন্ত্র : রাষ্ট্র ও ধর্ম অভিন্ন। ধর্মীয় নীতিই রাষ্ট্রীয় নীতির ভিত্তি। উদাহরণ : মদিনা সনদে ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে সামাজিক ন্যায় ও সমতা প্রতিষ্ঠা করা হয়। পশ্চিমা গণতন্ত্র : রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ। ধর্মীয় বিশ্বাস ব্যক্তিগত ব্যাপার; রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে ধর্মের কোনো আনুষ্ঠানিক ভূমিকা নেই।
৪. নেতৃত্ব ও প্রতিনিধি নির্বাচন। ইসলামিক গণতন্ত্র : যোগ্যতা, তাকওয়া (আল্লাহভীতি) ও আমানতদারিতার ভিত্তিতে নেতা নির্বাচিত হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভোট গুরুত্বপূর্ণ হলেও শরিয়াহর সীমাবদ্ধতার বাইরে কাউকে নেতৃত্বে আনা বৈধ নয়। পশ্চিমা গণতন্ত্র : ভোটের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়। ব্যক্তিগত ধর্মীয় বা নৈতিক যোগ্যতা প্রাথমিক বিবেচ্য নয়, বরং জনপ্রিয়তা বা রাজনৈতিক প্রভাব মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
৫. মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা। ইসলামিক গণতন্ত্র : মানবাধিকার নিশ্চিত, তবে তা আল্লাহর নির্ধারিত সীমার মধ্যে। যেমন, বাকস্বাধীনতা রয়েছে, কিন্তু তা অন্যের সম্মান বা ধর্মের অবমাননা করার অনুমতি দেয় না। উদাহরণ : ইসলামে গীবত, অপবাদ বা ধর্মবিদ্বেষী উক্তি নিষিদ্ধ। পশ্চিমা গণতন্ত্র : ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিসর অনেক বিস্তৃত। বাকস্বাধীনতার নামে ধর্মানুভূতি আঘাত করারও বৈধতা পাওয়া যায় (যেমন : কার্টুন বিতর্ক)।
৬. ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ধরন। ইসলামিক গণতন্ত্র : ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাপকাঠি হলো শরিয়াহর নীতিমালা। ধনী-গরিব, মুসলিম-অমুসলিম সবাই সমান ন্যায়বিচার পায়। উদাহরণ : রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘তোমার প্রিয়জন হলেও যদি অন্যায় করে, তবে তার বিরুদ্ধেই সাক্ষ্য দাও।’ পশ্চিমা গণতন্ত্র : ন্যায়বিচার মানবিক চাহিদা ও সাংবিধানিক নীতির ভিত্তিতে নির্ধারিত। তবে অনেক সময় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা প্রভাব ফেলে।
বাস্তবিক চিত্র ও সমসাময়িক চ্যালেঞ্জ : বর্তমানে মুসলিম বিশ্বে ইসলামিক গণতন্ত্রের আদর্শ প্রতিষ্ঠা চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। কারণ : পশ্চিমা প্রভাব ও সেকুলার মতাদর্শের প্রসার, ইসলামি নেতৃত্বের দুর্বলতা ও বিভাজন, ইসলামিক শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে ভুল ধারণা প্রচার, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক চাপ ও অর্থনৈতিক নির্ভরতা, অন্যদিকে, পশ্চিমা গণতন্ত্রও নানা সংকটে জর্জরিত, যেমন : গণমাধ্যম ও করপোরেট প্রভাবের মাধ্যমে জনমত নিয়ন্ত্রণ, নীতিহীন রাজনীতি ও বিভাজন, সামাজিক নৈতিকতার অবক্ষয়।
ইসলামিক গণতন্ত্রের সম্ভাবনা : যদি ইসলামি মূল্যবোধের ভিত্তিতে নেতৃত্ব গঠিত হয়, তবে ইসলামিক গণতন্ত্র : ন্যায়বিচার ও সামাজিক সমতার ভিত্তিতে শাসন নিশ্চিত করতে পারে, দুর্নীতিমুক্ত নেতৃত্ব গড়ে তুলতে পারে, জনগণের অধিকার ও দায়িত্বের মধ্যে সুষম ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে, মানবিক মর্যাদা ও নৈতিকতা সংরক্ষণ করতে পারে।
ইসলামিক গণতন্ত্র ও পশ্চিমা গণতন্ত্রের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য মূলত সার্বভৌমত্ব, আইন প্রণয়ন, ধর্মের ভূমিকা ও নৈতিকতার মানদণ্ডে নিহিত। ইসলামিক গণতন্ত্র মানবকল্যাণের জন্য আল্লাহর নির্ধারিত সীমার মধ্যে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে চায়; অপরদিকে পশ্চিমা গণতন্ত্র জনগণের ইচ্ছাকে সর্বোচ্চ মাপকাঠি ধরে। ইসলামিক গণতন্ত্র যদি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়, তবে তা মানবজাতিকে প্রকৃত ন্যায়, শান্তি ও কল্যাণের পথে পরিচালিত করতে সক্ষম। সুতরাং, বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ইসলামিক গণতান্ত্রিক মডেল গড়ে তোলা সময়ের দাবি।