গাজার মধ্যাঞ্চলের দেইর আল-বালাহ এলাকায় একটি স্বাস্থ্য ক্লিনিকের সামনে পুষ্টিকর খাদ্য সহায়তার লাইনে ড্রোন হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। ফলে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় ড্রোন হামলায় অন্তত ১৫ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে আটজন শিশু এবং দুইজন নারী রয়েছেন বলে জানিয়েছে আল-আকসা শহীদ হাসপাতাল।
হাসপাতাল থেকে প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা গেছে, মেঝেতে পড়ে আছে একাধিক শিশুর মরদেহ, আহতদের চিকিৎসায় ব্যস্ত ডাক্তাররা।এই ঘটনাকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন হিসেবে আখ্যা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাহায্য সংস্থা প্রজেক্ট হোপ, যারা এই ক্লিনিকটি পরিচালনা করে।ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করেছে, তারা হামাসের ‘সন্ত্রাসীদের’ লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে এবং বেসামরিক নাগরিকদের মৃত্যুতে দুঃখ প্রকাশ করেছে। একদিকে যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা চললেও, বাস্তব পরিস্থিতি অত্যন্ত রক্তক্ষয়ী রূপ নিয়েছে।প্রজেক্ট হোপ জানায়, ঘটনাটি ঘটেছে বৃহস্পতিবার সকালে।তখন বহু মানুষ ক্লিনিকের বাইরে জড়ো হয়েছিলেন অপুষ্টি, সংক্রমণ এবং অন্যান্য শারীরিক সমস্যার চিকিৎসা নিতে। প্রত্যক্ষদর্শী ইউসুফ আল-আইদি বলেন, ‘হঠাৎ ড্রোনের শব্দ শুনি, তারপর বিকট বিস্ফোরণ। চারপাশ কেঁপে উঠল এবং মুহূর্তেই রক্ত আর কান্নায় ভরে গেল চারদিক।’ঘটনার পরের মর্মান্তিক দৃশ্য ছড়িয়ে পড়ে সোশ্যাল মিডিয়ায়।বিবিসি যাচাই করা ফুটেজে দেখা গেছে, শিশুরা রাস্তায় পড়ে আছে, কেউ নড়াচড়া করছে না, কেউ গুরুতর আহত। আল-আকসা হাসপাতালের মর্গে জানাজার আগে নিহত শিশুদের দাফনের জন্য সাদা কাফনে মুড়িয়ে কাঁদছিলেন আত্মীয়রা। এক নারী জানান, তার গর্ভবতী ভাগ্নি মানাল ও তার কন্যাশিশু ফাতিমাও নিহতদের মধ্যে রয়েছেন। মানালের ছেলে আইসিইউতে ভর্তি। মানালের আত্মীয় ইন্তিসার বলেন, ‘ওরা তো শুধু বাচ্চাদের জন্য খাবার আনতে গিয়েছিল। পাশে থাকা এক অন্য নারী কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘কি অপরাধে ওদের মেরে ফেলা হলো? আমরা পুরো বিশ্বের চোখের সামনে মারা যাচ্ছি। সাহায্য চাইতে গিয়েও প্রাণ দিতে হচ্ছে।’প্রজেক্ট হোপের প্রেসিডেন্ট রাবিহ তোরবে বলেন, ‘এই ক্লিনিকগুলো গাজার মানুষের শেষ ভরসা। এখানে মা-শিশু স্বাস্থ্যসেবা, অপুষ্টির চিকিৎসা, সংক্রমণের সেবা দেওয়া হয়। অথচ আজ সেই সহায়তা পাওয়ার লাইনে দাঁড়ানো পরিবারগুলোকে নিশানা করা হলো। এটা নিছক বর্বরতা।’তিনি আরো বলেন, ‘এটি শুধু একটি যুদ্ধাপরাধ নয়, বরং এটাও প্রমাণ করে—যুদ্ধবিরতির আলোচনা চললেও গাজায় কেউই নিরাপদ নয়।’ইউনিসেফ প্রধান ক্যাথেরিন রাসেল এই হামলাকে ‘অযৌক্তিক ও মানবতার বিরুদ্ধে’ আখ্যা দিয়ে বলেন, ‘সাহায্য পাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে পরিবারের নিহত হওয়া মেনে নেওয়া যায় না।’ ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) দাবি করেছে, তারা হামাসের অভিজাত নুখবা ইউনিটের এক সদস্যকে লক্ষ্য করেই হামলা চালিয়েছে। যিনি ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলায় অংশ নিয়েছিলেন। আইডিএফ বলেছে, ঘটনার তদন্ত চলছে এবং বেসামরিক প্রাণহানির জন্য তারা দুঃখিত।একই দিনে, গাজার দক্ষিণের আল-মাওয়াসি উপকূলীয় এলাকায় একটি তাঁবুতে ড্রোন হামলায় পাঁচজন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে হামাস পরিচালিত সিভিল ডিফেন্স। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, বালির নিচ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে তিনটি শিশুর মরদেহ।এদিকে, যুদ্ধবিরতি চুক্তি নিয়ে আলোচনা চললেও তা স্থবির অবস্থায়। একজন ইসরায়েলি কর্মকর্তা জানিয়েছেন, চুক্তি হতে এক থেকে দুই সপ্তাহ লাগতে পারে। নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘যুদ্ধবিরতির প্রথম দিন থেকেই স্থায়ী শান্তির আলোচনা শুরু হবে।’ তবে এজন্য হামাসকে নিরস্ত্র হতে হবে।ডানপন্থি মার্কিন মিডিয়া নিউজ ম্যাক্সকে তিনি জানান, হামাস এখনও প্রায় ৫০ জন জিম্মি ধরে রেখেছে, যাদের মধ্যে ২০ জন জীবিত এবং ৩০ জনের বেশি সম্ভবত মৃত। হামাস বলেছে, তারা ১০ জন জিম্মি মুক্তির প্রস্তাবে নমনীয়তা দেখালেও, একটি ব্যাপক চুক্তি চায়। যা ইসরায়েলি আগ্রাসন বন্ধ করবে।ইউরোপীয় ইউনিয়ন জানিয়েছে, তারা ইসরায়েলের সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছেছে, যাতে আরো সাহায্য প্রবেশপথ খোলা, অবকাঠামো পুনর্গঠন ও সাহায্য কর্মীদের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি রয়েছে।জাতিসংঘও জানিয়েছে, চার মাস পর প্রথমবারের মতো গাজায় কিছু পরিমাণ জ্বালানি প্রবেশ করেছে। তবে তা একদিনের চাহিদারও কম। অবিলম্বে পর্যাপ্ত জ্বালানি সরবরাহ না পৌঁছালে, হাসপাতাল ও পানি পরিশোধন কেন্দ্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। গাজার ৯০ শতাংশের বেশি বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা, পানি, খাদ্য, জ্বালানি, ওষুধ––সবকিছুরই তীব্র ঘাটতি চলছে। অধিকাংশ মানুষ বহুবার বাস্তুচ্যুত হয়েছেন এবং মানবিক সংকট এখন চরমে।