চীনের নতুন জাতীয় শিশু ভাতার খবর শুনে প্রথমে আনন্দিত হয়েছিলেন হাংঝৌয়ের তরুণী মা ওয়াং ইউইয়ান। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই তার উচ্ছ্বাস মিলিয়ে গেল। কারণ তিনি বুঝতে পারলেন, ভাতার টাকায় শুধু শিশুর ডায়াপার আর দুধের বাড়তি খরচও পুরোপুরি মেটানো সম্ভব নয়।
ওয়াং জানান, তার চার মাস বয়সী সন্তানের জন্য যে ডায়াপার তিনি কিনে থাকেন, সেটির দাম জুলাই মাসে সরকারি নীতিমালা ঘোষণার পর কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ১৪৩ ইউয়ান (প্রায় ১৯.৯০ ডলার) থেকে বেড়ে ১৫৮ ইউয়ানে পৌঁছেছে।মাসে টিকা, দুধ, জামাকাপড়সহ সন্তানের প্রাথমিক খরচই প্রায় ৪,০০০ ইউয়ান। অথচ নতুন ভাতা বছরে প্রতিটি তিন বছরের কম বয়সী সন্তানের জন্য মাত্র ৩,৬০০ ইউয়ান—যা এই বিপুল খরচের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল।তিনি বলেন, আমি দ্বিতীয় সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা করছি না। কারণ খরচ খুব বেশি।ওয়াং-এর মতো আরো অনেকেই একই অভিজ্ঞতার কথা জানাচ্ছেন। চীনের নতুন জাতীয় শিশু ভাতা প্রকল্প আসলে জন্মহার বাড়ানোর এক সরকারি উদ্যোগ, কিন্তু অভিভাবক ও বিশ্লেষকরা বলছেন—এ ধরনের পদক্ষেপ বাস্তবে সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনায় তেমন কোনো প্রভাব ফেলবে না। সত্যিকারের পরিবর্তন আনতে হলে সরকারকে আরো বড় ধরনের সংস্কার করতে হবে, বিশেষ করে শিশু প্রতিপালনের ব্যয় কমানোর ক্ষেত্রে, যা চীনে বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় বেশি।জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকলে চলতি শতাব্দীর শেষে চীনের জনসংখ্যা অর্ধেকেরও বেশি হ্রাস পাবে।কর্মক্ষম জনশক্তি দ্রুত কমছে, বিপরীতে ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে মানুষের সংখ্যা বেড়ে চলেছে; যা শ্রমবাজার, স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক নিরাপত্তার ওপর বিশাল চাপ সৃষ্টি করছে।এই সংকট মোকাবিলায় স্থানীয় প্রশাসন থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় সরকার পর্যন্ত নানা উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে শিশু ভাতা, বর্ধিত মাতৃত্বকালীন ছুটি, ডেটিং অনুষ্ঠান, এমনকি এক বছরের বিনামূল্যে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়ার ঘোষণা পর্যন্ত এসেছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, এগুলোও যথেষ্ট নয়।বেইজিং-ভিত্তিক ইউওয়া পপুলেশন রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, চীনে একটি শিশুকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত লালন-পালনে গড়ে ৫ লাখ ৩৮ হাজার ইউয়ান খরচ হয়—যা দেশের মাথাপিছু জিডিপির ছয় গুণেরও বেশি।তুলনায় অস্ট্রেলিয়া ও ফ্রান্সে এই ব্যয় মাথাপিছু জিডিপির মাত্র দ্বিগুণের সামান্য বেশি, আর যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানে চার গুণের কাছাকাছি।কিন্তু এটিও শুধুমাত্র সরাসরি খরচ। আরো বড় চাপ আসে ‘মাদারহুড পেনাল্টি’ থেকে—অর্থাৎ সন্তান নেওয়ার পর কর্মজীবী নারীর আয় কমে যাওয়া, চাকরিতে ফিরে আসতে সমস্যা, বেতন বৈষম্য ও পদোন্নতিতে পিছিয়ে পড়া। আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা গেছে, নারীরা গড়ে জীবদ্দশায় প্রায় ২০% আয় হারান। চীনের ক্ষেত্রেও গড়ে প্রায় ৫ লাখ ৭০ হাজার ইউয়ান সম্ভাব্য আয় হারান মায়েরা—যা শিশুপালনের সরাসরি খরচের চেয়েও বেশি।ওয়াং নিজেই চাকরি ছেড়ে সন্তান লালন-পালনে নেমে পড়েছেন। তার কথায়, ‘আগে আমি নিজের মতো করে টাকা খরচ করতে পারতাম, এখন সেটা সম্ভব নয়।’আরো অনেক তরুণী একই কথা বলছেন। ঝেজিয়াং প্রদেশের জিয়াশিং শহরের ২৬ বছরের শেন দানইউ মন্তব্য করেন, আমি শুধু ১০ হাজার ইউয়ানের জন্য সন্তান নেব না। তার মতে, প্রকৃত সমস্যা হচ্ছে চাকরি পাওয়া, বয়সভিত্তিক বৈষম্য, উচ্চ বাসাভাড়া আর অতিরিক্ত চাপের শিক্ষা ব্যবস্থা।গবেষকরা বলছেন, শুধু নগদ প্রণোদনা দিয়ে খুব কম মানুষ সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা বদলান। হয়তো কিছু শহরে সাময়িকভাবে জন্মহার বেড়েছে, কিন্তু সেটি সাধারণত আগে থেকে পরিকল্পিত সন্তানের জন্ম কিছুটা এগিয়ে আনার ফল।তবে এই ভাতার ইতিবাচক প্রভাবও আছে। নিম্ন আয়ের এলাকায় এটি তুলনামূলকভাবে বেশি সহায়ক। উদাহরণস্বরূপ, আনহুই প্রদেশে এই ভাতা গড়ে এক বাসিন্দার বার্ষিক ব্যবহারযোগ্য আয়ের প্রায় ১০%। ফলে স্থানীয় পরিবারগুলোর জন্য এটি উল্লেখযোগ্য সহায়তা।তবুও বিশ্লেষকরা একমত—জন্মহার সত্যিকারে বাড়াতে হলে গভীর অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো সমাধান করতে হবে। এর মধ্যে অনিশ্চিত চাকরি, ব্যয়বহুল আবাসন, অপর্যাপ্ত শিশুসেবা, আর পুরুষ-নারীর মধ্যে দায়িত্ব ভাগাভাগির অভাব।হংকং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির অধ্যাপক স্টুয়ার্ট গিয়েটেল-বাস্টেনের ভাষায়, ‘কেবল অর্থ নয়, বরং কাজ, পরিবার ও লিঙ্গ ভূমিকার মধ্যে ভারসাম্য তৈরি করতে হবে—মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি নতুন কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন।’ওয়ুসাওয়া অ্যাডভাইজরির লিউর মতে, চীনের কম জন্মহার আসলে আধুনিক নারীদের নীরব প্রতিবাদ। নারীরা একা যেন পুরো মাতৃত্বের বোঝা না টানেন—পুরুষদেরও সন্তান লালন-পালনে সমানভাবে যুক্ত করতে হবে।