সরকার যদি আরো বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বৈশ্বিক বাজারে বড় অংশীদারি অর্জন ও অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে চায়, তাহলে সব শিল্প খাতের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। তবে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে ব্যবসায়ীদের এমন প্রত্যাশা থাকলেও এই দিকটি গুরুত্ব পায়নি বলে মন্তব্য করেছেন প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী আহসান খান চৌধুরী।
চলতি মাসের শুরুর দিকে বাজেট ঘোষণার পর ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আহসান খান চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশকে একটি উন্নত দেশে পরিণত করতে হলে আয়ের উৎস সৃষ্টিকারী খাতগুলোকে আরো শক্তিশালী করতে হবে।’তিনি আরো বলেন, ‘হাজার হাজার ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরি ও রপ্তানিমুখী শিল্পগুলোকে আরো প্রতিযোগিতামূলক করে তুলতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দর আধুনিকীকরণ ও আরো তিনটি বন্দরকে একই মানে উন্নীত করার মতো জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া দরকার ছিল।এই ব্যবসায়ী মনে করেন, বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে ৯০ দিনের একটি কর্মপরিকল্পনা নেওয়ার মতো সাহসী উদ্যোগ বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করা যেত। ‘কিন্তু এই ধরনের মানসিকতার প্রতিফলন বাজেটে দেখা যায়নি’ বলে মন্তব্য করেন তিনি। পাশাপাশি বলেন, ‘উদাহরণস্বরূপ, পোশাকশিল্প, যেটি দেশের রপ্তানির ৮০ শতাংশের বেশি, এই খাতে তিন বছরের মধ্যে দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধি বা আকার দ্বিগুণ করার লক্ষ্য নির্ধারণ কি সম্ভব ছিল না? নিশ্চয়ই ছিল।’ব্যবসায়ীরা অনেক দিন ধরেই রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ দাবি করে আসছেন বলেও উল্লেখ করেন প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী।তিনি বলেন, ‘ব্যবসার জন্য পানি ও অবকাঠামোর মতো বিদ্যুৎ-গ্যাসও মৌলিক প্রয়োজন। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে আমাদের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সংস্কারের জন্য যথেষ্ট আন্তরিক প্রচেষ্টা দেখিনি।’নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘একজন ব্যবসায়ী হিসেবে, একটি গ্যাস সংযোগ লাইন সম্প্রসারণ করতেই আমাকে অফিসে অফিসে ঘুরতে হয়। এটি ক্লান্তিকর।তবুও গ্যাস সরবরাহ নিয়ে স্পষ্ট কোনো নির্দেশনা পাই না। এর ফলে ব্যাবসায়িক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী। তাদের বার্ষিক ব্যবসার পরিমাণ প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার। এই গ্রুপের অধীনে প্রায় ৩৪টি কম্পানি রয়েছে এবং প্রায় দেড় লাখ মানুষ সেখানে কাজ করে।তারা প্রতিবছর ১৪৫টি দেশে প্রায় ৫৫০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে।আহসান খান চৌধুরী বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা সাধারণত বলি : আমাদের গ্যাস দিন, নিরাপত্তা দিন, দক্ষ বন্দর দিন, ঢাকা-চট্টগ্রাম ভালো সংযোগ দিন, উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে উন্নত লজিস্টিকস দিন, চাঁদাবাজদের হাত থেকে মুক্তি দিন। এসব বাজেটে না-ও থাকতে পারে, কিন্তু বাজেটের দিকনির্দেশনায় এসব থাকলে ভালো হতো।’তার মতে, নতুন বাজেট আগের বাজেটগুলোর মতোই, যদিও মানুষ পরিবর্তনের আশা করেছিল। মানুষ সংস্কার, মৌলিক পরিবর্তন, সম্পদের ন্যায্য বণ্টন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য নতুন ধরনের বাজেট চায় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কিন্তু আমার দৃষ্টিকোণ থেকে এটি একটি প্রচলিত, রুটিন বাজেট। যারা বাজেটটি প্রস্তুত করেছেন তাদের সাধুবাদ জানাই। কারণ অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও তারা এটি করেছেন। তবে আমি মনে করি না, এটি বাংলাদেশের ব্যাবসায়িক পরিবেশে উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন আনবে।শীর্ষস্থানীয় এই ব্যবসায়ী আরো বলেন, নতুন বাজেটে করজাল সম্প্রসারণে নতুন কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। ফলে বিদ্যমান করদাতাদের ওপরই চাপ বাড়বে।আহসান খান চৌধুরী মিডল্যান্ড ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবেও নিযুক্ত আছেন। ক্ষুদ্র ব্যবসা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, কৃষক ও গ্রামীণ উদ্যোক্তাদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। উচ্চ সুদের হারের কারণে ক্ষুদ্র ব্যবসা চরম চাপের মুখে। তিনি ক্ষুদ্রঋণ সহজলভ্য করার ওপর জোর দেন, যাতে সম্মিলিতভাবে দেশ এগিয়ে নেওয়া যায়। একই সঙ্গে তিনি শিক্ষা খাতে অধিক বিনিয়োগের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশকে ভিয়েতনাম বা ফিলিপাইনের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, ওরা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে অনেক বেশি ব্যয় করে।’আহসান খান চৌধুরী বিশ্বাস করেন, শুধু বিদেশি বিনিয়োগের ওপর বাংলাদেশের নির্ভর করার দরকার নেই। তিনি বলেন, ‘আমাদের ১৮ কোটি মানুষের দেশ। অসংখ্য দক্ষ উদ্যোক্তা রয়েছে, যারা পরিবর্তন আনতে পারে। কিন্তু তারা নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ে। যদি আমরা ব্যাবসায়িক পরিবেশে পরিবর্তন আনতে চাই, তাহলে সাহসী পদক্ষেপ নিতে হবে। উদ্যোগ ছাড়া নতুন সম্ভাবনা উন্মোচিত হবে না।’তিনি ফার্নিচারশিল্পের কথা বলেন, যেটি রপ্তানি সম্ভাবনাময়, কিন্তু এখনো মূলত স্থানীয় বাজারের ওপর নির্ভরশীল। ‘বন্ড সুবিধা না থাকলে এসব খাত কখনো রপ্তানিতে যেতে পারবে না। রপ্তানি সম্ভাবনাময় খাতগুলোকে বন্ড সুবিধা দিতে হবে।’টার্নওভার ট্যাক্স এক শতাংশে বাড়ানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি এটিকে খুব নেতিবাচকভাবে দেখি। বাংলাদেশে খুব অল্প এসএমই ১০ শতাংশ লাভ করতে পারে। ১ শতাংশ টার্নওভার ট্যাক্স মানে তাদের ওপর কার্যকর করহার অনেক বেশি হয়ে যাচ্ছে।’এনবিআরকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘আপনারা আগে দেখেন ছোট ব্যবসাগুলো কত লাভ করে। যদি তাদের মোট বিক্রয়ের ওপর এক শতাংশ কর দিতে হয়, তাহলে সেটা টেকসই হবে কি?’প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান মনে করেন, এতে করে দুর্নীতি ও অসুস্থ চর্চার সুযোগ তৈরি হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা এই চোর-পুলিশ খেলায় অনেক সময় নষ্ট করি। এনবিআরের চ্যালেঞ্জগুলো আমরা বুঝি। কিন্তু ব্যবসা বৃদ্ধির জন্য সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। যদি আমরা কমপ্লায়েন্স, আয় ও ব্যবসার গতি বাড়াতে পারি, তাহলে করজাল বিস্তৃত করা সম্ভব।’তাইওয়ানের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘তাদের জনসংখ্যা আমাদের চেয়ে কম, কিন্তু তারা অনেক বেশি রপ্তানি করে। এর মানে এই নয় যে আমাদের প্রতিভা নেই। বাংলাদেশের তরুণরা, কর্মীরা অসাধারণ সক্ষম।’বাংলাদেশে ব্যবসা করা অত্যন্ত কঠিন স্বীকার করে এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘কিন্তু সব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও দেশ এগোচ্ছে। যতই কঠিন হোক, পারিবারিক অবস্থা যতই খারাপ হোক, ঋণ শোধ করা যতই কষ্টকর হোক, সামনে এগিয়ে যান। ইতিবাচক থাকুন। দেশকে একটা সুযোগ দিন। দেশে বিনিয়োগ করুন। আর আপনার বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যান।’তার মতে, যদি এমনটা হয়, তাহলে হয়তো এ বছরের মতো জনঅসন্তোষ আর দেখা যাবে না। ‘নইলে একের পর এক প্রতিবাদ হবে এবং আমরা অগ্রগতি অর্জনে ব্যর্থ হবো।’এই শীর্ষ ব্যবসায়ী তরুণদের গঠনমূলক অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘সংস্কার আসবে, যারা দায়িত্বে আছেন তারা নিজেদের দায়িত্ব পালন করবেন। আপনার কাজ হলো পড়াশোনা করা। শিক্ষায় ও কারিগরি দক্ষতায় মনোযোগ দিন। যেসব জ্ঞান আপনাকে আগ্রহী করে, সেদিকে মনোযোগ দিন। আসুন, সত্যিকারের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাই। তখনই আমরা প্রকৃত অগ্রগতি দেখতে পাব।’