‘চুক্তি পণ্ড করার চেষ্টায় ইসরায়েল’
জার্মান ইনস্টিটিউট ফর গ্লোবাল অ্যান্ড এরিয়া স্টাডিজ (জিআইজিএ)-এর গবেষক ডিবা মিরযায়ি বলেন, এই হামলা আলোচনার ঠিক আগের দিন হওয়া মোটেও কাকতালীয় নয়।
তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি না ইসরায়েল কেবল আলোচনা পণ্ড করতে চেয়েছে। আমার ধারণা, তারা সম্পূর্ণভাবে আলোচনাটি ধ্বংস করতে চেয়েছে, যাতে ইরান আলোচনায় অংশ নেওয়া বাদ দেয়।’লন্ডনের এসওএএস বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক অধ্যাপক সৈয়দ আলী আলাভি বলেন, এই হামলা রবিবারের আলোচনার ওপর নিঃসন্দেহে এক বিশাল ছায়া ফেলবে – যদি আলোচনা হয়ই। তিনি বলেন, ‘ইরানের ওপর এমন সরাসরি হামলা ইরান-ইরাক যুদ্ধের পর এই প্রথম। এটি ওয়াশিংটন ও তেহরানের চলমান আলোচনায় অবশ্যই প্রভাব ফেলবে, বিশেষত রবিবারের বৈঠকে।’তিনি যোগ করেন, ‘তেহরান এখনো এই বৈঠক নিয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক বার্তা দেয়নি। এর মানে এই নয় যে আলোচনা একেবারে বাতিল হয়ে গেছে – সম্ভবত এগুলো আরো উত্তপ্ত পরিবেশে চালিয়ে যাওয়া হবে।’ মিরযায়ি ইরানি রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের বরাতে বলেন, এই হামলায় ইরানের পক্ষ থেকে আলোচনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লাহ খামেনির উপদেষ্টা আলি শামখানি গুরুতরভাবে আহত বা নিহত হয়েছেন।তিনি বলেন, ‘আলোচনায় অংশ নেওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তি এখন হয় নিখোঁজ, না হয় শারীরিকভাবে অক্ষম।’
ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়াহামলার পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এক ভিন্ন সুরে কথা বলেছেন। যুক্তরাষ্ট্র হামলায় কোনো সম্পৃক্ততা অস্বীকার করলেও জানিয়েছে, ইসরায়েল আগেই জানিয়ে দিয়েছিল প্রেসিডেন্ট নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ স্যোশালে-এ হামলাটিকে কঠোর কূটনৈতিক অবস্থানের বিজয় হিসেবে উপস্থাপন করেন।তিনি লিখেন, ‘আমি ইরানকে বারবার চুক্তির সুযোগ দিয়েছি। আমি তাদের বলেছিলাম, ‘এগিয়ে যাও’, কিন্তু তারা কিছুতেই সফল হতে পারেনি।’ তিনি আরো বলেন, ‘ইতোমধ্যেই অনেক মৃত্যু ও ধ্বংস হয়েছে, তবে এখনো সময় আছে এই হত্যাযজ্ঞ থামানোর – পরবর্তী হামলাগুলো আরো ভয়াবহ হবে। ইরানের এখন চুক্তি করা উচিত, নাহলে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।’
কয়েক ঘণ্টা পর তিনি আবার পোস্ট করেন, জানান যে দুই মাস আগে তিনি ইরানকে ৬০ দিনের আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন। তিনি লেখেন, ‘দুই মাস আগে আমি ইরানকে ৬০ দিনের সময়সীমা দিয়েছিলাম চুক্তি করার জন্য। তারা তা করেনি। আজ ৬১তম দিন। এখন হয়তো তাদের দ্বিতীয় সুযোগ রয়েছে!’
দীর্ঘ প্রস্তুতির ফল
ডিবা মিরযায়ি বলেন, আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর অবস্থান ট্রাম্প প্রশাসনের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে – যিনি তার প্রথম মেয়াদেই ইরান-সংক্রান্ত বহুপাক্ষিক পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নিয়েছিলেন।তিনি বলেন, ‘আমি নিশ্চিত না ট্রাম্প প্রশাসন এই পারমাণবিক আলোচনায় কতটা আন্তরিক। যুক্তরাষ্ট্র চায় ইরান যেন এমনকি বেসামরিক ব্যবহারের জন্যও পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার না করে – যা অতিরিক্ত দাবি। এমনটি কোনো দেশকে করতে হয় না। পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি অনুযায়ী, প্রতিটি দেশেরই শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের অধিকার আছে। তাই, ইরান এরকম শর্ত মানবে না।’এই সপ্তাহেই ইরানের শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পারমাণবিক কর্মসূচি সীমিত রাখার ইচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, যখন আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা জানায়, ইরান পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তির আওতায় তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। প্রায় ২০ বছর পর এই প্রথমবারের মতো ইরানকে তিরস্কার করে আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার জবাবে তেহরান রেগে গিয়ে একটি ‘নিরাপদ’ স্থানে নতুন সমৃদ্ধিকরণ কেন্দ্র স্থাপনের ঘোষণা দেয়।মিরযায়ি বলেন, ‘ আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার এই তিরস্কার অত্যন্ত কঠোর। এতে যে সব নিয়ম লঙ্ঘনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তা ইঙ্গিত দেয় ইরানও উত্তেজনা কমাতে খুব একটা আগ্রহী নয়।’ইসরায়েল, মধ্যপ্রাচ্যে একমাত্র পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশ, বরাবরই একটি ইরানকে অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসেবে বর্ণনা করে এসেছে। হামলার পর প্রথম ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুও সেই কথা পুনর্ব্যক্ত করেন।মিরযায়ি বলেন, ‘১০ বছর আগের প্রথম চুক্তির সময়ও ইসরায়েল ব্যাপকভাবে বাধা দিয়েছিল। শুক্রবারের হামলার মাত্রা দেখলেই বোঝা যায়, এটি বহু মাসের পরিকল্পনার ফল।’ তিনি বলেন, ‘এই হামলার মূল প্ররোচক ছিল ইরান-যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক আলোচনা, আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার তিরস্কার নয়। এ ধরনের বড়সড় আক্রমণ এক-দুদিনে পরিকল্পনা করা যায় না – এটি হয়ত বহু সপ্তাহ, এমনকি মাস ধরে পরিকল্পিত ছিল।’
উল্লেখ্য, ইসরায়েলি হামলার পাল্টা জবাবে শুক্রবার রাতে এবং শনিবার ভোরে একাধিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে ইরান। এই হামলায় প্রায় ৮০ জন আহত হয়েছে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে তিনজন মারাত্মকভাবে আহত হয়ে পরে মারা যান।