বিতর্কিত অতীত, প্রগতিশীল ভাবমূর্তিগরিব পরিবারে জন্ম নেওয়া লি ছিলেন একাধারে একজন বিতর্কিত, আবার সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় নেতা।ইনচনের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যাপক ড. লি জুন-হান বলেন, ‘লি জে-মিয়ংয়ের জীবনে ছিল নানা উত্থান-পতনের গল্প। তার বেশ কিছু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বিতর্ক তৈরি করেছিল।’২০২২ সালের নির্বাচনে সার্বজনীন মৌলিক আয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আলোচনায় আসেন লি। কেউ তাকে সাহসী সংস্কারক হিসেবে দেখেছেন, আবার কেউ দেখেছেন সন্দেহের চোখে।ড. লি বলেন, ‘তিনি ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রচলিত ধারার বাইরে একজন ‘বহিরাগত’ ছিলেন, তবুও নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন।’
মধ্যপন্থার প্রচারণা, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গুরুত্বএইবারের প্রচারণায় লি কিছুটা মধ্যপন্থী অবস্থান নেন। বড় ব্যবসা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক, বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে আসন্ন আলোচনার দিকটি সামনে আনেন।এক স্মৃতিকথায় লি তার কষ্টময় শৈশবের কথাও তুলে ধরেন। ১৯৬৩ সালে আন্দংয়ের একটি পাহাড়ি গ্রামে জন্ম নেওয়া লি কিশোর বয়সে কারখানায় কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় হাত ভেঙে ফেলেন।এরপর আইনি লড়াই করে লেখাপড়ায় ফিরে এসে ১৯৮৬ সালে বার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।প্রায় দুই দশক মানবাধিকার আইনজীবী হিসেবে কাজ করার পর ২০০৫ সালে তিনি রাজনীতিতে আসেন। তিনি সিওংনামের মেয়র (২০১০) ও গিয়ংগি প্রদেশের গভর্নর (২০১৮) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
আদালত ও অভিযোগে ঘেরা লির ক্যারিয়ার
লি জে-মিয়ংয়ের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ছিল বহু বিতর্ক ও মামলার ঘূর্ণিপাকে ঘেরা। ২০২৩ সালের একটি জমি উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতি, ঘুষ ও প্রতারণার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে আনা হয়। এ ছাড়া ২০২১ সালের প্রেসিডেন্ট বিতর্কে লি দাবি করেছিলেন, তিনি কিম মুন-কি নামের একজন বিতর্কিত ব্যক্তিকে চিনতেন না। কিন্তু পরে প্রমাণ আসে তিনি মিথ্যা বলেছিলেন, যা নির্বাচনি আইনের লঙ্ঘন। ২০২৪ সালের নভেম্বরে আদালত তাকে দোষী সাব্যস্ত করে এক বছরের স্থগিত কারাদণ্ড দেয়। পরবর্তীতে আপিল আদালত খালাস দিলেও সর্বোচ্চ আদালত সেই রায় বাতিল করে। মামলাটি এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।
রাজনৈতিক সংকট থেকে সুযোগ
৩ ডিসেম্বর রাতে সাবেক প্রেসিডেন্ট ইউন সামরিক আইন জারি করেন, ‘রাষ্ট্রবিরোধী শক্তি’ দমন ও উত্তর কোরিয়ার হুমকি ঠেকানোর অজুহাতে। এ ঘোষণা জনমনে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দেয়।লি দ্রুত অনলাইনে এসে জনগণকে সংসদ ভবনের সামনে জড়ো হতে বলেন। হাজারো মানুষ সাড়া দেয়, সংঘর্ষ হয় পুলিশের সঙ্গে। সংসদ সদস্যরা এবং লি বেড়া টপকে সংসদে প্রবেশ করেন। এরপর ডেমোক্র্যাটিক পার্টি প্রেসিডেন্ট ইউনের অভিশংসনের প্রস্তাব আনে, যা ২০২৫ সালের ৪ এপ্রিল সাংবিধানিক আদালতে গৃহীত হয়। ৯ এপ্রিল লি দলের নেতৃত্ব থেকে সরে গিয়ে প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হন। ২৭ এপ্রিল প্রাইমারিতে বিপুল ভোটে জয়ী হন তিনি। সামরিক শাসনের ব্যর্থতা ও জনপ্রতিনিধিদের একতা ইউনের পতন ঘটায়, এবং ক্ষমতাসীন পিপিপি দল কার্যত ভেঙে পড়ে।
ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা
লি জে-মিয়ং এখন প্রেসিডেন্ট হলেও তার ভবিষ্যৎ এখনো আদালতের রায়ের ওপর ঝুলে আছে। নির্বাচনের আগ পর্যন্ত মামলা স্থগিত থাকলেও পরবর্তীতে যদি তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়, তবে দক্ষিণ কোরিয়া নতুন এক রাজনৈতিক সংকটে পড়তে পারে। তবুও, লি জে-মিয়ংয়ের বিজয় প্রমাণ করে, দারিদ্র্য, বিতর্ক ও বিপদ পেরিয়েও কেউ রাষ্ট্রের শীর্ষপদে পৌঁছাতে পারেন, যদি তার সঙ্গে থাকে সঠিক সময়, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও জনসমর্থন।