প্রতিটি রাষ্ট্রব্যবস্থায় শিল্প-কারখানা স্থাপনের জন্য সরকার প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সুবিধা প্রদান করে। জনগণের ট্যাক্স থেকেই সরকার ওই সুবিধা প্রদান করে। সব বিষয় বিবেচনায়ই শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক জনগণ।
কিছু সময় ধরে শিল্পোদ্যোক্তা রাজনৈতিক দলের সক্রিয় সদস্য হিসেবে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার নজির লক্ষণীয়। রাজনৈতিক পরিচয়ের মাধ্যমে নির্ধারিত হতো শিল্পোদ্যোক্তাদের রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ও ব্যাংক থেকে গৃহীত ঋণের পরিমাণ। অধিকন্তু উদ্যোক্তারা পুঁজিবাজারের সদস্যভুক্ত কিভাবে হবেন এবং কতটা ঝামেলামুক্তভাবে ব্যবসা করতে পারবেন তার নির্ধারকও ছিল রাজনৈতিক পরিচয়। সরকারি দলের বাইরে কোনো শিল্পোদ্যোক্তা নানা নিপীড়নের মাধ্যমে কোনো রকম নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হতেন। কোনো কোনো ব্যবসায়ী নিজের মতাদর্শকে বিলীন করে দিয়ে ব্যবসার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট দলের সদস্য হয়ে যেতেন। তাহলে ব্যবসায়ীসমাজ মোটামুটিভাবে পুরোটাই হতে হবে সরকারি দল। এতে ওই সরকার যত দিন ক্ষমতায় টিকে থাকবে, তত দিন পর্যন্ত তিনি ঝামেলামুক্তভাবে তাঁর ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারবেন। আর ভিন্নমতাবলম্বীরা প্রতিকূলতার মাঝে টিকে থাকার জন্য চেষ্টা করবেন।
রাজনৈতিক ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়, পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ওই ব্যবসায়ীর ওপর নেমে আসে বিভিন্ন ধরনের হয়রানি, যা তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্যকে আবার ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়। ফলে তাঁকে নানা দিকের উপদ্রব সহ্য করতে হয় এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যবসা বেদখল হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে ব্যবসার দীর্ঘদিনের টানাপড়েনের মধ্যে নতুন করে যুক্ত হয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি, যার পরিণতিতে ধীরে ধীরে খেলাপি ঋণগ্রহীতার তালিকায় তাঁর নাম অন্তর্ভুক্ত হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় নতুন ঋণের সংস্থান করতে ব্যর্থ হন। গ্যাস, বিদ্যুত্, অবকাঠামো সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন এবং শিল্পের সংকোচন হয়। রাজনৈতিক টানাপড়েনের শেষ ধাক্কাটা আসে আপামর জনতার ওপর। ভোক্তা ও আমানতকারীর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করে এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে ভাটা পড়তে শুরু করে।
ব্যক্তির নিজস্ব রাজনৈতিক মতামত থাকতে পারে। এটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার একটি মৌলিক উপাদান। ব্যবসায়ী বলে তাঁকে সব সময় সরকারি দল করতে হবে এমনটি হওয়া উচিত নয়। শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে দেখতে হবে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মতো, যা দেশের প্রতিটি ব্যক্তির সম্পদ।
রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে যেকোনো পরিবর্তনে শিল্প-কারখানাকে দুর্বল করার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কৌশল দৃশ্যমান। লুটপাট, ভয়ভীতি প্রদর্শন, অসহনীয় চাঁদাবাজির ফলে দুর্বল হয় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ভিত। এ কাজের সঙ্গে সত্যিকার অর্থে কোনো রাজনৈতিক দলের সম্পৃক্ততা না থাকলেও স্বার্থান্বেষীচক্র এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে।
কখনো ভীতসন্ত্রস্ত মালিক আত্মগোপন করেন আবার কখনো মূলধন ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার অভাবে বন্ধ হয়ে যায় শিল্পপ্রতিষ্ঠান।
জিডিপির প্রবৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থানের প্রয়োজনে সব প্রতিষ্ঠান সচল রাখতে হবে। কোনো রপ্তানিকারী শিল্প-কারখানা বন্ধ হলে আন্তর্জাতিক বাজার হারানোর আশঙ্কা থাকে। বিরূপ প্রভাব পড়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে। অভ্যন্তরীণ বাজারে বিপণনযোগ্য পণ্যসামগ্রী উৎপাদন বন্ধ হওয়ার ফলে দেশের অভ্যন্তরে সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়ে। এই সুযোগগুলোকে লুফে নেবে সংশ্লিষ্ট পণ্যের রপ্তানিকারক দেশগুলো। বিরূপ প্রভাব পড়বে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ওপর। দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠান; যথা—ব্যাংকিং ব্যবস্থা এবং পুঁজিবাজারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। অর্থনীতি এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থার এই দুঃসময়ে যদি ১০ শতাংশ শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে ভেবে দেখতে হবে আমাদের জিডিপির ওপর কী নেতিবাচক প্রভাব পড়ে? এর ওপর যদি ১০ শতাংশ লোক নতুন করে বেকারত্বের কবলে পড়ে, তাহলে কী পরিমাণ সামাজিক অবক্ষয় নেমে আসবে, তা অনুমান করা সত্যি অনেক কঠিন। হাজারো অব্যবস্থাপনাকে মোকাবেলায় সরকার এমনিতেই হিমশিম খাচ্ছে, তার ওপর যদি অনিবারণযোগ্য সমস্যা সরকার ও জনগণের সামনে উপস্থিত হয়, তাহলে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি ভেঙে পড়বে এবং দেশ একটি নিয়ন্ত্রণহীন রাষ্ট্রে পরিণত হবে।
অপরাধী যে পরিচয়েরই হোক না কেন, তাকে আইনের মুখোমুখি করা প্রয়োজন। ব্যক্তির অপরাধের প্রভাব প্রতিষ্ঠানের ওপর পড়লে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আপামর জনগণ তথা রাষ্ট্র।
আমাদের দেশে এখনো শক্তিশালী করপোরেট কালচার গড়ে ওঠেনি। তাই একটি শক্তিশালী দক্ষ ব্যবস্থাপনা পর্ষদ গঠন করে হলেও শিল্প-কারখানার উৎপাদনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। এ জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধির সমন্বয়ে আপৎকালীন ম্যানেজমেন্ট কনসালট্যান্ট নিয়োগ করা যেতে পারে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোক্তা এবং দক্ষ ও সত্ পেশাদার ব্যক্তিদের সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠান সচল রাখার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। সেনাবাহিনীর মাধ্যমে দক্ষ ও পেশাদার ব্যক্তিদের সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন এবং বণ্টনের ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রাখার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। সফল ও দক্ষ সমগোত্রীয় উদ্যোক্তাদের সমন্বয়ে অথবা সংশ্লিষ্ট ট্রেড বডির সমন্বয়ে শিল্প-কারখানা সচল রাখার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় আমাদের মানবসম্পদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কারিকুলাম তাত্ত্বিকের পরিবর্তে প্রায়োগিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা সময়ের দাবি। শিক্ষাব্যবস্থায় করণিক সৃষ্টির বিপরীতে নির্বাহী ও উদ্যোক্তা সৃষ্টির পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর দেশের শিল্প-কারখানা পরিচালনার জন্য বিদেশ থেকে দক্ষ জনবল আমদানি করা সত্যি আমাদের জন্য সম্মানজনক নয়।
আমাদের দেশের সব শিল্প-কারখানা সচল রাখতে হবে। উদ্যোক্তা হতে পারেন রাজনৈতিক, শিল্প-কারখানা অরাজনৈতিক। রাজনীতি কোনো অপরাধ নয়। রাজনীতির আবরণে অপরাধীচক্র এবং সুবিধাভোগীরা আইনের মুখোমুখি হোক, এটি জনগণের প্রত্যাশা। অন্যদিকে জনগণের সম্পদ শিল্প-কারখানাকে সবার ঊর্ধ্বে স্থান দিয়ে দেশের উৎপাদন, কর্মসংস্থান এবং সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এ দেশ হোক রপ্তানিমুখী দেশ, অন্য দেশের বাজার নয়। সব শিল্পপ্রতিষ্ঠান সচল থাকবে, এটিই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, ব্যাংকার্স ক্লাব অব বাংলাদেশ লিমিটেড