সিসা শুধু শিল্পকারখানায় ব্যবহার উপযোগী ধাতু নয়, বরং এটি মানুষের জন্য এক শক্তিশালী ও অদৃশ্য বিষ। এটি মানবদেহে প্রবেশ করে বছরের পর বছর হাড়ে জমা হতে থাকে এবং ধীরে ধীরে মস্তিষ্কসহ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষতি করে। সিসার বিষক্রিয়া একবার শুরু হলে তা স্থায়ী হয়ে যায় এবং মস্তিষ্কের বিকাশ, শারীরিক বৃদ্ধি ও দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সমস্যা, যেমন– হৃদরোগ, স্নায়ুতন্ত্র এবং প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলে। শিশুদের ক্ষেত্রে এটি বুদ্ধিমত্তা কমিয়ে দেয় এবং তাদের শেখার ক্ষমতা ও আচরণে ব্যাঘাত ঘটায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, রক্তে সিসার কোনো নিরাপদ মাত্রা নেই।বাংলাদেশ সিসা বিষক্রিয়ার সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি। ২০২২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে আইসিডিডিআর,বি এবং স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকায় বসবাসরত সব শ্রেণির দুই থেকে চার বছর বয়সী ৫০০ শিশুকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি প্রতিনিধিত্বমূলক গবেষণা পরিচালনা করেছি। এই গবেষণার ফলাফল ছিল অত্যন্ত উদ্বেগজনক।গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি শিশুর রক্তেই সিসার উপস্থিতি পেয়েছি আমরা। উদ্বেগের বিষয় হলো– গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ৯৮ শতাংশ শিশুর রক্তে সিসার মাত্রা ছিল ‘সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি)’ নির্ধারিত রেফারেন্স মাত্রা ৩৫ মিলিগ্রাম/লিটারের বেশি। এর মধ্যে ৫০ শতাংশ শিশুর রক্তে সিসার মাত্রা ৬৭ মিলিগ্রাম/লিটারের বেশি ছিল।গবেষণায় অংশগ্রহণকারী শিশুদের রক্তে মাত্রাতিরিক্ত সিসার পরিমাণের সঙ্গে পরিবেশগত কারণের সুস্পষ্ট সম্পর্ক পাওয়া গেছে।যেসব শিশু সিসা নির্গমনকারী শিল্পকারখানার (যেমন– ব্যাটারি পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র, ধাতু গলানোর কারখানা ইত্যাদি) এক কিলোমিটারের মধ্যে বসবাস করে, তাদের রক্তে সিসার মাত্রা ৫ কিলোমিটার দূরে বসবাসকারী শিশুদের তুলনায় ৪৩ শতাংশ বেশি পেয়েছি আমরা।ঢাকায় প্রায় ৩.৮ মিলিয়ন বা ৩৮ লাখ মানুষ এই ঝুঁকিপূর্ণ সীমার মধ্যে বসবাস করছে। শিল্পসংশ্লিষ্ট উৎস ছাড়াও সিসাদূষণের অন্যান্য পারিবারিক উৎসের মধ্যে রয়েছে গৃহস্থালির ধুলাবালি, রান্নার পাত্র, প্রসাধনী এবং ঘরের ভেতরে ধূমপান করার অভ্যাস। ঘরের ভেতরে ধূমপান করা হয় এমন ঘরে যেসব শিশু থাকে, তাদের রক্তে সিসার মাত্রা ১২ শতাংশ বেশি পাওয়া গেছে। এই গবেষণায় আর্থসামাজিক বৈষম্যও লক্ষ্য করেছি।যেমন– দরিদ্র পরিবারগুলোর শিশুরা তুলনামূলকভাবে অধিক সিসা বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে।সবচেয়ে হতাশার ব্যাপার হলো এই সংকট সম্পূর্ণভাবে মানুষের সৃষ্ট। বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার মাধ্যমে সিসাদূষণের উৎসগুলো চিহ্নিত করা গেছে এবং এর ক্ষতিও পরিমাপযোগ্য। এই সমস্যার প্রতি উদাসীনতার প্রভাব শুধু হাসপাতালেই নয় বরং শ্রেণিকক্ষে, কর্মক্ষমতায় এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশেও প্রভাব ফেলবে। তবে আশার কথা হলো, এটি একটি প্রতিরোধযোগ্য সমস্যা।
সফলতার উদাহরণআইসিডিডিআর,বির আগের এক গবেষণার ফলাফলে আমরা দেখেছি, অন্তঃসত্ত্বা নারীদের মধ্যে সিসা বিষক্রিয়ার একটি প্রধান উৎস ছিল আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহৃত সিসামিশ্রিত হলুদ গুঁড়া। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের নেতৃত্বে বিধিমালার কার্যকর প্রয়োগ এবং জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমের ফলে ২০১৯ সালে হলুদের ৪৭ শতাংশ নমুনায় সিসার উপস্থিতি হ্রাস পেয়ে ২০২১ সালের মধ্যে প্রায় শূন্যে নেমে আসে। এই সফল প্রকল্পের ফলে একই সময়ে অন্তঃসত্ত্বা নারীদের রক্তে সিসার মাত্রাও উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। এটি আমাদের জন্য একটি অনুকরণীয় উদাহরণ; যেখানে বিজ্ঞান, নীতিমালা ও জনগণের অংশগ্রহণ একত্র হয়ে জনস্বাস্থ্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে।
সুপারিশ
আমাদের গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে ঢাকাসহ নগরজীবনে সিসা সংকট মোকাবিলায় একগুচ্ছ বাস্তবমুখী ও নীতিগত সুপারিশ প্রস্তাব করতে পারি। সিসা নির্গমনকারী শিল্পগুলোকে আবাসিক এলাকা ও বিদ্যালয়ের কাছ থেকে স্থানান্তর করতে হবে।সিসাযুক্ত পণ্য, যেমন– সিসাযুক্ত রং, রান্নার পাত্র, প্রসাধনী ও শিশুদের ব্যবহৃত সামগ্রীর ওপর কঠোর নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা জরুরি। জনস্বাস্থ্য রক্ষায় সিসার ক্ষতি ও প্রতিরোধ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।পারিবারিক পর্যায়ে সিসামুক্ত ও নিরাপদ বিকল্প পণ্য নির্বাচনে সচেতনতা ও উৎসাহ প্রদান করতে হবে। নিয়মিত পানি ও মপ বা কাপড় দিয়ে ঘরের ধুলা পরিষ্কারের মতো পরিচ্ছন্নতামূলক অভ্যাস প্রচার করতে হবে। ঘরের ভেতরে ধূমপান করাকে নিরুৎসাহিত করতে হবে। পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাসে, যেমন– আয়রন, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণের অভ্যাস গড়ে তোলাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।তবে প্রযুক্তিগত সমাধানের বাইরেও এই সংকট সমন্বিত ও অংশগ্রহণভাবে নিবেদন করতে হবে। নীতনির্ধারক, শিল্পকারখানার প্রধান, সামাজিক সংগঠন ও পরিবারে অভিভাবক সবারই এ সংকট মোকাবিলায় সম্মিলিতভার কাজ করতে হবে।এটি শুধু একটি স্বাস্থ্যগত সমস্যা নয়; বরং এটি একটি সামাজিক সংকটও, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে হুমকির মুখে ফেলছে। শিশুদের সিসা থেকে রক্ষা করা মানে জাতির ভবিষ্যৎ করা। এই সংকট নিরসনে একত্রে জরুরি এবং কার্যকরভাবে পদক্ষেপ নেওয়ার এখনই সময়।
এ ক্যাটাগরির আরো নিউজ..