জুলাই আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এক শিক্ষার্থী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্র্যাইব্যুনালে দেওয়া সাক্ষ্যে বললেন, পঙ্গু হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার সময় শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘নো রিলিজ, নো ট্রিটমেন্ট।’
২০২৪ সালের ১৯ জুলাই কোটাবিরোধী আন্দোলন চলাকালে রাজধানীর বিজয়নগর এলাকায় গুলিবিদ্ধ ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল ইমরান সোমবার (৪ আগস্ট) বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ এই সাক্ষ্য দেন।গুলিবিদ্ধ হয়ে অচল হয়ে যাওয়া বাঁ পা নিয়ে সাক্ষীর ডায়াসে বসে ইমরান তার সাক্ষ্যে বলেন, “২০২৪ সালের জুলাইয়ের শুরু থেকে কোটাবিরোধী যৌক্তিক আন্দোলনে আমি সম্পৃক্ত ছিলাম। ১৯ জুলাই বিজয়নগর পানির টাংক এলাকায় আন্দোলনরত অবস্থায় পুলিশ আমাদের ওপর অতর্কিত গুলি করে।আমি গুলিবিদ্ধ হই ও সেখানে আমার দুই সহযোদ্ধা নিহত হন। আমার বাঁ পায়ের হাঁটুর নিচে গুলি লাগে। এরপর আমাকে বিভিন্ন হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। তবে কোনো প্রাইভেট হাসপাতাল আমাকে ভর্তি করতে অপারগতা প্রকাশ করে।পরে মিটফোর্ড হাসপাতালে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে চিকিৎসকরা আমার বাঁ পা কেটে ফেলার কথা বলেন। আমি পা কেটে ফেলার পক্ষে ছিলাম তবে আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা পা কাটার অনুমতি দেয়নি। পরে মিডফোর্ড হাসপাতাল থেকে আমাকে পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলা হয়।এরপর আমাকে পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। গত বছরের ২৬ বা ২৭ জুলাই পঙ্গু হাসপাতালে আমাদের দেখতে আসেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার আসা উপলক্ষে আগের রাত থেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা চলতে থাকে হাসপাতালে। এ জন্য আমাদের রাতে ঘুমের সুযোগও দেওয়া হয়নি। শেখ হাসিনা এসে আমাদের খোঁজখবর নিচ্ছিলেন।তখন আমার সঙ্গে তার কথা হয়। তখন আমি তাকে ম্যাডাম বলে সম্বোধন করলে আপা বলে ডাকতে বলেন। আমি কোথায় পড়াশোনা করি, হলে থাকি কিনা সে সম্পর্কে তিনি জানতে চান। এক পর্যায়ে তিনি বুঝতে পারেন আমরা আন্দোলনকারী। তিনি আমাকে আরো জিজ্ঞাসা করেন যে, তুমি কি দেখেছো পুলিশ তোমাকে গুলি করেছে? আমি বলি যে পুলিশ আমাকে গুলি করেছে। তবে পুলিশের পোশাকে কে ছিল তা আমি জানি না। আমার পরেও উনি চার-পাঁচজনের সঙ্গে হাসপাতালে কথা বলেন। পরে উনি যখন চলে যাচ্ছিলেন তখন হেল্প ডেস্কের কাছে গিয়ে ‘নো রিলিজ, নো ট্রিটমেন্ট’ অর্ডার দিয়ে যান। যা আমি শুনতে পাই। তখন বুঝিনি তিনি এটা বলে কী বুঝিয়েছেন। পরবর্তীতে আমার ঠিকঠাক ট্রিটমেন্ট দেওয়া হচ্ছিল না। আমার পা পচে যাচ্ছিল। গন্ধে আশপাশে কেউ থাকতে পারত না। হাসপাতালে সাপ্লাই করা অ্যান্টিবায়োটিক আমার শরীরে কাজ করছিল না। কিন্তু বাইরে থেকে কিনে আনারও অনুমতি ছিল না। তখন আমার বাবা আমাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজের চেষ্টা করেন, কিন্তু আমাকে রিলিজ দেওয়া হয়নি। পরে আমি বুঝতে পারি শেখ হাসিনার ‘নো রিলিজ, নো ট্রিটমেন্ট’ অর্ডারের ফলে আমাকে রিলিজ দেওয়া হচ্ছে না। তারা চাচ্ছিল আমার পা কেটে ফেলে পরবর্তীতে জেলে পাঠাতে। তবে গত ৫ আগস্টের পর হাসপাতালের সাধারণ বেড থেকে কেবিনে নেওয়া হয়। এখন যথাযথ চিকিৎসা চলছে। এখন পর্যন্ত আমার পায়ে ২৫টি অপারেশন সম্পন্ন হয়েছে। তবে আমার বাঁ পা মুভমেন্ট হয় না, এটা কখোনো সুস্থ হবে না।”এক পর্যায়ে সাক্ষী আব্দুল্লাহ আল ইমরান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে বলেন, ‘আমার এই অবস্থার জন্য শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক আইজি দায়ী। কারণ তারাই গুলির নির্দেশ দেন সে কারণে পুলিশ গুলি করে।’ এই সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণের পর তাকে জেরা করা হয়। জেরা করেন শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন।আজ ট্রাইব্যুনাল প্রসিকিউসন পক্ষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম ও প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম শুনানি করেন। এ সময় অপর প্রসিকিউটররা উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে, শেখ হাসিনার পক্ষে ছিলেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন। আর এই মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে ট্রাইব্যুনালে হাজির হওয়া আসামি সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ।গতকাল এই মামলায় সূচনা বক্তব্য উপস্থাপনের পর ট্রাইব্যুনালে প্রথম সাক্ষ্য দেন খোকন চন্দ্র বর্মণ। তিনি গত বছরের ১৮ জুলাই নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় তার সামনে সংঘটিত হতাহতের ঘটনা ও গুলিতে নিজের মুখমণ্ডল বিকৃত হওয়ার বিষয়ে সাক্ষ্য দেন।