তাঁর পিতা ফয়জুর রহমান আহমেদ ছিলেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা এবং মা আয়েশা ফয়েজ। পিতার সরকারি চাকরির সুবাদে হুমায়ূন আহমেদের শৈশব কেটেছে সিলেট, পঞ্চগড়, রাঙামাটি, বগুড়া, পিরোজপুরসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।
হুমায়ূন আহমেদ বগুড়া জেলা স্কুল থেকে ১৯৬৫ সালে বিজ্ঞান বিভাগে ম্যাট্রিক (রাজশাহী বোর্ডে সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান) এবং ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৭০ সালে স্নাতক (সম্মান) ও ১৯৭২ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়।পরের বছর, ১৯৭৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন। পরবর্তীকালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পলিমার রসায়নে গবেষণা করে ১৯৮২ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন দীর্ঘদিন, কিন্তু পরবর্তীতে লেখালেখির স্বার্থে অধ্যাপনা পেশা থেকে অবসর নেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রাবস্থাতেই তাঁর সাহিত্য প্রতিভার স্ফুরণ ঘটে। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’, যা বাংলা কথাসাহিত্যে এক নতুন শৈলী ও সংলাপের জন্ম দেয়। এরপর ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘শঙ্খনীল কারাগার’।
হুমায়ূন আহমেদ-এর লেখার মূল বৈশিষ্ট্য ছিল সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, অতিপ্রাকৃত ও পরাবাস্তবতাকে সহজ ভাষায় ফুটিয়ে তোলা। তিনি বাংলা সাহিত্যকে এক বিশাল পাঠকগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দেন। তাঁর সৃষ্ট দুটি চরিত্র আজও বাঙালি পাঠকের মননে অমর।
হিমু : যুক্তিবুদ্ধিহীন, হলুদ পাঞ্জাবি পরিহিত, ভবঘুরে এক যুবক, যিনি তার নিজস্ব জীবনদর্শন নিয়ে হেঁটে চলেন।
মিসির আলি : যুক্তিবাদী, মনস্তত্ত্ববিদ, যিনি রহস্য ও অতিপ্রাকৃত ঘটনার ব্যাখ্যা দেন বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে।
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ এবং ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘দেয়াল’ তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা দুই শতাধিক।
নাটক ও চলচ্চিত্র : গণমানুষের বিনোদন
সাহিত্যের পাশাপাশি তিনি নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাণেও বিশেষ সাফল্য অর্জন করেন। উল্লেখযোগ্য নাটক : ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘বহুব্রীহি’, ‘কোথাও কেউ নেই’ (যার ‘বাকের ভাই’-এর ফাঁসি নিয়ে জনবিক্ষোভ হয়েছিল), ‘আজ রবিবার’।উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র : ‘আগুনের পরশমণি’ (জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত), ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘দুই দুয়ারি’ এবং ‘ঘেটুপুত্র কমলা’
শেষ জীবন ও প্রয়াণ
দীর্ঘ চার দশকের বর্ণাঢ্য সাহিত্যজীবনে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮১), একুশে পদক (১৯৯৪)-সহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন।
২০১১ সালে তাঁর শরীরে কোলন ক্যান্সার ধরা পড়ে। দীর্ঘ চিকিৎসা শেষে ২০১২ সালের ১৯ জুলাই তিনি নিউ ইয়র্কের বেলভিউ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মাত্র ৬৩ বছর বয়সে তাঁর প্রয়াণ বাংলা সাহিত্যে এক অপূরণীয় ক্ষতি। লেখকের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী, তাঁকে তাঁর প্রিয় গাজীপুরের নুহাশপল্লীতে সমাহিত করা হয়। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর লেখার মাধ্যমে আজও কোটি পাঠকের হৃদয়ে অমর হয়ে আছেন।