বর্তমানে আমরা এক উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে বসবাস করছি। বিংশ শতাব্দীর নতুন নতুন উদ্ভাবনী পৃথিবীকে বদলে দিয়েছে। বদলে গেছে জনজীবন। নিমিষে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের সচিত্র খবরাখবর এখন হাতের মুঠোয়। ভাবা যায় এসব পরিবর্তন। মনে পড়ে সেই লাঙল, জোয়াল, গরুর গাড়ি, কাঁচা রাস্তার কাদা, ধুলো-বালিতে যখন আমাদের দিন চলত এক সময়। দিন চলত কুপির আলোয় পড়াশোনার কথা।
যেখান থেকে বেড়িয়ে এসেছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো গুণিজনরা। তাদের শরীরের কাদামাটি এখনো আমাদের শুধুই ভাবায়। ভাবায় ৭-৮ মাইল হেঁটে স্কুল, কলেজের জীবন কেমন ছিল। কলেরা বসন্তের মতো রোগে গ্রামের পর গ্রাম মৃত্যুর ভয়ঙ্কর বিভীষিকা স্মৃতির পাতাকে নেড়ে দেয়। আমাদের বিজ্ঞানীরা, বিদগ্ধজনেরা এ পৃথিবীকে বদলে দিয়েছে আজ। আগে বিদ্যুৎহীন সময়ে বিচারকের রুমে জজের মাথার ওপর রশি ধরে পাখা টানত সেই পিয়নের কথা মনে আছে কি? হ্যাঁ মনে আছে আমাদের অগ্রজদের। আজ আমরা প্রযুক্তির উন্নয়নে একটা সমৃদ্ধ জীবন ব্যবস্থা পেয়েছি। তবে আমরা সত্যিইকি উন্নত, পরিচ্ছন্ন, সভ্য জাতির সত্তার আলোয় আলোকিত। সবাই তো ভালোই চায়। অনেক সময় সেই ভালোর আলোয় অন্ধকার বাসা বাঁধে। দিনের আলো উপভোগ করার পর এক সময় অন্ধকার নেমে আসে। এটাই গতিপথের বিবর্তন প্রক্রিয়ার নিয়ম।আলফ্রেদ বেনহার্ড নোবেল (সুয়েডীয় আলফ্রেড নোবেল) জন্ম ২১ অক্টোবর ১৮৩৩ এবং মৃত্যু ১০ ডিসেম্বর ১৮৯৬ একজন সুয়েডীয় রসায়নবিদ, প্রকৌশলী উদ্ভাবক এবং অস্ত্র নির্মাতা। তিনি ডিনামাইট আবিষ্কার করেন এবং তার ব্যবসায়ে ও বিশেষ প্রসিদ্ধি অর্জন করেছিলেন। তিনি যে ডিনামাইট তৈরি করেছিলেন তা দিয়ে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় পাহাড় ভাঙা, পাহাড় ভেঙে রাস্তা তৈরি করা, টানেল তৈরি ও খনিতে। কারণ খুব সহজে ও কম খরচে ডিনামাইট দিয়ে এসব কাজ করা যায়। ১৮৬৭ সালে ডিনামাইট আবিষ্কার তার এক অভূতপূর্ব আবিষ্কার। এক সময় যুদ্ধক্ষেত্রে এটি প্রচুর ব্যবহৃত হতো। তবে নাইট্রোগ্লিসারিনের অস্থিতিশীলতার কারণে এবং বিশেষ করে ঠান্ডায় জমে যাওয়ার কারণে এটির সামরিক ব্যবহার এখন নেই। এ ডিনামাইট শান্তির উদ্দেশে ব্যবহার করা যায়। ডিনামাইটকে তার দিয়ে দূর থেকে বৈদ্যুতিক সিগন্যালের সাহায্যে বিস্ফোরণ ঘটানো হয় এবং এ বিস্ফোরক অনবরত জ্বলতে থাকে। ভালো কাজের জন্য তার এ উদ্ভাবনী যখন যুদ্ধে এবং অন্যান্য ধ্বংসাত্মক কাজে ব্যবহার হতে লাগল তখন নোবেল খুবই অনুতপ্ত হলেন। তিনি প্রচুর অর্থ-বৈভবের অধিকারী হন এই ডিনামাইট আবিষ্কারের কারণে।তার এ উদ্ভাবনী যখন জনগণের ক্ষতির কারণ হয়ে যায় তখন তিনি মৃত্যুর আগে তার সব সম্পত্তি একটি ট্রাস্টি বোর্ডের কাছে উইল করে দেন এবং সেখানে শর্ত থাকে যে, তার এই অর্থ যেন শান্তির কাজে ব্যবহৃত হয়। যার ফলে ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে প্রবর্তিত হয় আন্তর্জাতিক পুরস্কার নোবেল প্রাইজ। যা প্রতি বছর পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, সাহিত্য, বিশ্বশান্তি, চিকিৎসায় এবং অর্থনীতিতে মানবজাতির জন্য অনবদ্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এ পুরস্কার দেওয়া হয়। পুরস্কার প্রদানের দায়িত্বে যে প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়োজিত তারা সবাই ঠিক করে অক্টোবর মাসে লরিয়টদের নাম ঘোষণা করেন। ঘোষণার পর ১০ ডিসেম্বর তারিখে আনুষ্ঠানিক পদক প্রদান করা হয়। কারণ এ দিনটি আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যুবার্ষিকী। সর্বপ্রথম বাঙালি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে এবং পরবর্তী সময়ে ১৯৯৮ সালে অমর্ত্যসেন অর্থনীতিতে এবং ২০০৬ সালে ড. মুহম্মদ ইউনূস শান্তিতে এ পুরস্কার জয় করেন। ২০১৯ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পান অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়।আবারো পূর্ব প্রসঙ্গে ফিরে আসি আমাদের এ পরমাণু প্রযুক্তির উন্নয়ন কখনো কখনো মানব জাতির জন্য হুমকি হয়ে দ্বারায়। তখন উদ্ভাবক ও উপকার ভোগীরা অসহায় হয়ে পড়ে। সারা বিশ্ব আজ অশান্ত। সারা বিশ্বে যুদ্ধের দামামা লেগেই আছে। পরমাণুকে আমরা নিজ নিজ স্বার্থে ব্যবহারে সবাই ব্যস্ত থাকি এবং এ কাক্সিক্ষত শক্তির স্বত্বাধিকারী হওয়ার জন্য সবাই ব্যতিব্যস্ত থাকি। কারণ কথায় আছে না ‘জোর যার মুলুক তার’। এ জোরের মূল উৎস পরমাণুশক্তি। পরমাণু অর্থ ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রনের সমন্বয়ে গঠিত মৌল পদার্থের সূক্ষ্মতম অংশ যার মধ্যে পদার্থের যাবতীয় ধর্ম বর্তমান। এবং প্রোটনের সংখ্যা পদার্থের ভিন্নতা নির্দেশক। দেশের পারমাণবিক প্রযুক্তি এমন এক প্রযুক্তি যা পারমাণবিক নিউক্লিয়াসের পারমাণবিক বিক্রিয়াকে জড়িত করে। উল্লেখ্য, পারমাণবিক প্রযুক্তির মধ্যে পারমাণবিক চুল্লি, পারমাণবিক ওষুধ এবং পারমাণবিক অস্ত্র। এটি অন্যান্য জিনিসের মধ্যে স্মোক ডিটেক্টর এবং বন্দুকের দর্শনীয় স্থানেও ব্যবহৃত হয়। পারমাণবিক প্রযুক্তির কাজ বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি পারমাণবিক প্রযুক্তির আরো অনেক উপকারী ব্যবহার করা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে কৃষি থেকে চিকিৎসা, মহাকাশ অনুসন্ধান থেকে জল বিশুদ্ধকরণ।
বিশ্বের অনেক দেশে কৃষি শ্রমিকরা ক্ষতিকারক পোকামাকড়ের বংশবৃদ্ধি রোধ করতে বিকিরণ ব্যবহার করে। শক্তিতে শক্তি বাড়ে। এ আলাদিনের চেরাগ পাওয়ার জন্য সবাই উদগ্রীব থাকে। এ জন্য এ শক্তিধরেরা পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ করে দাপটের সঙ্গে। সেখানে নীতি, নৈতিকতার কোনো জায়গা থাকে না। এখন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ঠুঁটো জগন্নাথের মতো হয়ে পদবিধারী সংস্থা প্রধান হয়ে থাকে। এ লাঠিয়াল কালচার ক্রমান্বয়ে পৃথিবীকে ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে নীতি নৈতিকতার কোনো স্থান নেই বলে অনুমিত হয়। ক্রমান্বয়ে নীতির হ্রাস ও দুর্নীতির উত্থান পরিলক্ষিত হয় সারা বিশ্বে। বিশ্ব আজ গর্ব করার মতো উন্নয়নের চেয়ে উন্নয়নভোগীদের কাছে হুমকিস্বরূপ। এ প্রেক্ষাপটে আমাদের আরো বিবেকবান ও নীতি নৈতিকতার বাণী সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমেই শুধু শান্তির সুবাতাস বইতে পারে। জাতিসংঘের সংস্থাগুলো আরো নিরপেক্ষ হয়ে আরো বিবেকের রুদ্ধদ্বারে আঘাত করতে হবে তাহলে একদিন জাগ্রত বিবেকের আঁধার কেটে যাবে এবং আমরা পরিচ্ছন্ন, সুন্দর পরমাণুর কল্যাণকর ব্যবহারে মনোযোগী হব। নিজেকে শান্তিতে রাখতে গেলে প্রতিবেশী সবাইকে শান্তিতে রাখা জরুরি। যুদ্ধবিগ্রহ কোনো দিন শান্তির কথা বলে না। বলে না বিবেকের জবাব অস্ত্রের মাধ্যমে দেওয়ার। এ ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ও ন্যায্য ব্যবহার জরুরি। তা ছাড়া প্রকৃতির ওপর খড়্গ উঠালে প্রকৃতিও বিরূপ আচরণ করবে একদিন। উল্লেখ্য, বিশ্ব পানিবণ্টন ব্যবস্থা উদার নৈতিক হওয়া প্রয়োজন। তেমনি আন্তর্জাতিক গমনাগমনের পথও উন্মুক্ত হওয়া প্রয়োজন। এতে করে বিশ্ব বিবেকের আদান প্রদানে শান্তির পথও উন্মুক্ত সংকীর্ণতা কেটে উদার নৈতিকতার বায়ু প্রবাহিত হয়। উষ্ণতা কমে পৃথিবীর বুকে শীতলতা বিরাজ করবে একদিন এ প্রত্যাশা সবার।