জালিয়াতির বিস্তারিত চিত্র:
জান্নাত ট্রেডার্স : ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত খাদ্য সরবরাহের টেন্ডার পায় জান্নাত ট্রেডার্স। জুলাই মাসে নিয়ম অনুযায়ী খাদ্য সরবরাহ করলেও, আগস্ট থেকে ডিসেম্বর—এই পাঁচ মাস অতিরিক্ত খাদ্য উত্তোলন করে তারা। বিজিবি যেখানে ২৬৯ মেট্রিক টন চাল ও ৩০.১ মেট্রিক টন গমের চাহিদা দিয়েছিল, সেখানে ভুয়া চাহিদাপত্র দেখিয়ে খাদ্য গুদাম থেকে উত্তোলন করা হয়েছে ৩৭৩ মেট্রিক টন চাল ও ৪১.৪ মেট্রিক টন গম। অর্থাৎ, এই পাঁচ মাসে ১০৪ মেট্রিক টন চাল ও ১১.৩ মেট্রিক টন গম অতিরিক্ত উত্তোলন করা হয়েছে।জান্নাত ট্রেডার্স ২.৫৫ টাকা কেজি দরে উত্তোলন করা চাল কালোবাজারে বিক্রি করেছে ৪৮ টাকা কেজি দরে, এবং ২.১৫ টাকা কেজি দরে উত্তোলন করা গম কালোবাজারে বিক্রি করেছে ৪২ টাকা কেজি দরে। এখানে তারা বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়া নেয়।
জে কে এন্টারপ্রাইজ : ২০২৪ সালের শুরুতে আবারো টেন্ডার পায় জে কে এন্টারপ্রাইজ। প্রতিষ্ঠানটি পরপর তিন মেয়াদে টেন্ডার পায় এবং এই সময়ে চাহিদাপত্র জাল করে অতিরিক্ত ২৫৭.৪ মেট্রিক টন চাল ও ২৮.৫ মেট্রিক টন গম উত্তোলন করে কালোবাজারে বিক্রি করে দেয়।২০২৪ সালের ১২ মাসে বিজিবি ৬৬৪ মেট্রিক টন চাল ও ৭৩.১ মেট্রিক টন গমের চাহিদা দিয়েছিল। অথচ জে কে এন্টারপ্রাইজ উত্তোলন করেছে ৯২১.৪ মেট্রিক টন চাল ও ১০১.৬ মেট্রিক টন গম।প্রথম ৬ মাসে ২.৫৫ টাকা কেজি দরে উত্তোলন করা চাল কালোবাজারে ৪৮ টাকা কেজি দরে এবং ২.১৫ টাকা কেজি দরে উত্তোলন করা গম কালোবাজারে ৪২ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছে জে কে এন্টারপ্রাইজ।
জে কে এন্টারপ্রাইজের মালিকের চাঞ্চল্যকর স্বীকারোক্তি :
জে কে এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মো. জাফরের সঙ্গে কথা বললে উঠে আসে আরো চাঞ্চল্যকর তথ্য। তিনি জানান, শুধু ঠাকুরগাঁও জেলার ক্ষেত্রেই এমনটি করা হয়নি, সিলেট বিভাগের কয়েকটি ক্যাম্পেও একই অবস্থা করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘যে কাজটি হয়েছে সেটা আমি একা করিনি, সেখানে ভেতর এবং বাইরের অনেকেই জড়িত রয়েছে।’সুনির্দিষ্ট করে কারো নাম বলতে রাজি না হলেও, তিনি ইঙ্গিত দেন যে বিজিবির থেকে যে কাগজটি নিয়ে আসেন, সেই কাগজকে মূলত বিজিবির সদস্যরা নিয়ে আসেন। এরপর খাদ্য অধিদপ্তরের একজন উপজেলা কর্মকর্তা সেটি গ্রহণ করেন এবং খাদ্য বিজিবির সদস্যদের দেন। এভাবে চলতে থাকে প্রক্রিয়াটি। তিনি আরো দাবি করেন, ‘আমাকে ফাঁসানো হয়েছে, এখানে অনেকে জড়িত রয়েছে। কারণ এই খাদ্যটি আমি একা উঠানো সম্ভব না। মূলত এখানকার অনেকে জড়িত এবং তারাই আমাকে সহযোগিতা করেছে এবং এখান থেকে তারাও একটি অংশ সুবিধা নিয়েছে।’অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে আরো তথ্য। নিশ্চিন্তপুরের ব্যবসায়ী মো. মামুন একটি ঠিকাদারি কাজের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন বলে স্বয়ং ঠিকাদার স্বীকার করেছেন। তিনি এই কাজের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন বলে স্বীকার করেন। ঠিকাদারের ভাষ্যমতে, মো. মামুন ইতিমধ্যে তার কাছ থেকে দেড় লক্ষ টাকা গ্রহণ করেছেন। প্রতিনিধি মো. মামুনের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করে দেখা করার চেষ্টা করলেও তিনি দেখা করেননি। এই বিষয়ে তার বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি কোনো সাড়া দেননি।সরকারি কোষাগারের এমন ভয়াবহ লুটপাটে ঠাকুরগাঁওয়ের সচেতন মহল উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। তারা ঘটনার সঠিক তদন্ত এবং জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।অন্যদিকে, অনুসন্ধানে নামার পরপরই তদন্তে নেমেছে বিজিবি স্পেশাল টিম এবং ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে তিন কমিটির একটি টিম। ঠাকুরগাঁও ৫০ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তানজীর আহম্মদের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও কোনোভাবেই তাকে পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁও জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মাহমুদুল হাছান বলেন, আমরা এখান থেকে সঠিকভাবেই খাদ্য সরবরাহ করেছি। আমাদের কাগজের কোন সমস্যা নাই।অন্যদিকে, ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক ইশরাত ফারজানা জানিয়েছেন, বিষয়টি যাচাই করে কোনো ব্যত্যয় থাকলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ইতিমধ্যেই আমরা একটি ৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি করেছে। সেই কমিটি অনুসন্ধান করে সব তথ্য দেবে।