তথাকথিত জুলাই সনদ লুটেরা ও মাফিয়াশ্রেণির প্রতিনিধিদের সঙ্গে বন্দোবস্তের দলিলের অধিক কিছু নয়, অধিক কিছু হয়ে ওঠা অসম্ভব।
৪.ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে প্রধান উপদেষ্টা ‘জুলাই ঘোষণা’ দিতে দেননি। ৬ জুন ২০২৫ তিনি জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই মাসেই একটি ‘জুলাই সনদ’ প্রস্তুত করে জাতির সামনে উপস্থাপন করার কথা বলেছেন।তিনি বলেছেন, তথাকথিত ‘জুলাই সনদে’ একটা জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র নির্মাণের জন্য সংস্কার কমিশন যে প্রস্তাবগুলো দিয়েছে, সেগুলোর মধ্য থেকে রাজনৈতিক দলগুলো যে কটিতে একমত, তার তালিকা থাকবে। সেই জুলাই সনদে স্বাক্ষর করে রাজনৈতিক দলগুলো নাকি জাতির কাছে সেগুলো বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করবে।ব্যস। এতগুলো মানুষ শহীদ হলো আর এতগুলো মানুষ পঙ্গুত্বের জীবন বরণ করে নিল কেন? লুটেরা ও মাফিয়াশ্রেণি নিজেদের
মধ্যে কোথায় কোন বিষয়ে একমত হলো, সেই সনদের জন্য?যে রাজনৈতিক দলগুলো শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট শক্তি ও রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে কার্যত কিছুই করতে পারেনি, তারা এখন আমাদের ‘জাতীয় সনদ’ উপহার দেবে!জুলাই সনদ সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লবকে বৈধতা ও ন্যায্যতা দেওয়ার দলিল; গণ–অভ্যুত্থানের ঘোষণাকে নস্যাৎ করার প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা।‘জুলাই সনদ’ প্রকৃতপক্ষে ৫ আগস্টের মৌলিক গঠনতান্ত্রিক মুহূর্তকে (কনস্টিটুয়েন্ট মোমেন্ট) অস্বীকার করার কৌশল, যেখানে জনগণ বিদ্যমান রাষ্ট্রশক্তির বাইরে নতুন রাজনৈতিক কর্তৃত্ব হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল।জুলাই ঘোষণার অধিকার কেড়ে নেওয়া মানে জনগণের অভিপ্রায় ও আকাঙ্ক্ষাকে ‘অদৃশ্য’ করে ফেলা।
৫.জাতীয় ঐকমত্য কমিশন, তথাকথিত ‘সংস্কার কমিশন’, ‘জুলাই সনদ’ প্রভৃতি মূলত লুটেরা ও মাফিয়াশ্রেণির রাজনৈতিক প্রতিনিধি এবং বিদেশি স্বার্থান্বেষী শক্তির মধ্যকার নতুন বোঝাপড়ার প্রক্রিয়া ও দলিল।এতে স্পষ্টতই জনগণের অভিপ্রায়ের কথা নেই, আছে ‘অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ’ করে রাস্তায় নামা জনগণকে বাদ দিয়ে ‘ঐকমত্যের নামে’ সংলাপভিত্তিক রাজনৈতিক ক্ষমতা পুনর্বিন্যাসের সমঝোতা।কামাল আহমেদের লেখায় সংস্কারপন্থী বিবেচনা, যেমন বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, পুলিশ, জনপ্রশাসন ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে ‘গণতন্ত্রের কার্যকারিতা’ স্থাপনের দাবি করা হয়েছে।কিন্তু এগুলো এমন এক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর সংস্কারচেষ্টা, যার মৌলিক ভিত্তি হলো জনগণ থেকে কর্তৃত্ব কেড়ে নিয়ে শাসকশ্রেণির মধ্যে
ভাগ করে দেওয়া। জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতা এখানে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত; বরং এই সংস্কার বিদ্যমান ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার একটা কারিগরি বা কৌশল।কামাল আহমেদের লেখার সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রবণতা হলো ‘সবার ঐকমত্যে নতুন বাংলাদেশ নির্মাণ’—এই ভাষ্য। বাস্তবে এই ‘ঐকমত্য’ কীভাবে নির্ধারিত হচ্ছে? কে ঠিক করছে, কোন সুপারিশ গ্রহণযোগ্য, কোনটি নয়?জনগণের পক্ষ থেকে কোনো গণপরিষদ, গণশুনানি বা প্রতিনিয়ত সংলাপ তো দেখা যাচ্ছে না। জনগণকে বাদ দিয়ে রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐকমত্য স্থাপনের মধ্য দিয়ে যে ‘সনদ’ তৈরি হয়, তা কোনোভাবেই জনগণের সার্বভৌমত্ব কায়েম করতে পারে না।
৬.কামাল আহমেদের লেখাটিতে গণমাধ্যম সংস্কারের ঘাটতি ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে যে উদ্বেগ জানানো হয়েছে, সেটা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার অভ্যন্তরে বসে এবং সেই ব্যবস্থাকে অক্ষত রেখে কিছু ‘নৈতিক সংশোধন’ কামনা করা।কামাল আহেমদের চিন্তাভাবনার মধ্য দিয়ে সংবাদমাধ্যমকে একপ্রকারের ‘সরকারি বা করপোরেট স্বাধীনতা’ দেওয়ার চিন্তা ফুটে উঠেছে, যেখানে জনগণের তথ্য নিরীক্ষণের অধিকার ও জনগণের ভাষ্য নির্মাণের অধিকার মোটেও স্বীকৃত নয়।কামাল আহমেদ শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি, নিরাপত্তা, অধিকার ইত্যাদি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সেটা শূন্য বুলি ছাড়া কিছু হয়ে ওঠে না। কারণ, সাংবাদিক হিসেবে তিনি জানেন, এই তথাকথিত সনদ বা কমিশনের মধ্যে শ্রমিকদের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। এই অবস্থান শ্রমিকশ্রেণিকে ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে সরিয়ে রেখে তাদের আবার ‘সক্ষম শাসকদের দয়া’র অধীন করার চেষ্টা মাত্র।
৭.‘সংস্কার’ কথাটির বিপজ্জনক ব্যবহার সংস্কারপন্থীরা বুঝলেও অনেকে বুঝতে পারেন না। ‘সংস্কার’ শব্দটি ব্যবহৃত হচ্ছে এমনভাবে, যেন শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার দু–এক জায়গায় স্বল্প সংশোধন মানেই গণতন্ত্র। এতেই বুঝি জনগণের অধিকার আদায় হয়ে যাবে।আসলে ‘সংস্কার’ কথাটি জনগণের অভ্যুত্থান, বিদ্রোহ কিংবা নতুন গঠনতান্ত্রিক শক্তির দাবিয়ে রাখা বা নির্মূল করার ভাষিক অস্ত্র। জনগণের সার্বভৌম অধিকার হলো নিজেদের নিজেরা রাজনৈতিকভাবে গঠন করার ক্ষমতা, নিজেদের গঠনতন্ত্র, রাষ্ট্রকাঠামো এবং বিশ্বব্যবস্থায় নিজেদের যোগ্য স্থান নির্ধারণের অধিকার—সেটা লুটেরা ও মাফিয়াশ্রেণির প্রতিনিধিদের রাজনৈতিক দলের ‘ঐকমত্যে’ বন্দী হতে পারে না।
৮.কামাল আহমেদের লেখা গুরুত্বপূর্ণ হলেও শেষমেশ লেখাটি সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লবকে কৌশলে রক্ষা করার একটি দুর্বল ভাষ্য হয়ে রইল, তার অধিক কিছু হয়ে উঠতে পারল না।গণমাধ্যম শুধু জনগণের সামষ্টিক অভিপ্রায়ের কাছে জবাবদিহি করে, কিন্তু কোনো করপোরেট স্বার্থ, রাষ্ট্র, আমলাতন্ত্র বা পুলিশি ব্যবস্থার কাছে নয়। গণসার্বভৌমত্বের আলোকে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা নিয়ে কীভাবে আমরা ভাবব এবং গণমাধ্যমে চর্চা করব, তার কোনো নীতি বা দিশা কামাল আহমেদ দিতে পারলেন না। জনগণের অভ্যুত্থান গণসার্বভৌমত্ব কায়েমের মধ্য দিয়ে নিজেদের নতুনভাবে গঠন এবং একটি গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র প্রণয়নের প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য এটা আমাদের প্রয়োজন।
৯.জুলাই ঘোষণা হলো জনগণের নতুন গাঠনিক ক্ষমতার ঘোষণা; লুটেরা ও মাফিয়াশ্রেণির সঙ্গে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের জন্য জনগণ অকাতরে শহীদ হয়নি।গণসার্বভৌমত্ব কায়েমের অভিপ্রায় এবং জনগণের সামষ্টিক গাঠনিক ক্ষমতা ও গঠনের কর্তব্য ইত্যাদি সবকিছুকে পাশ কাটিয়ে পুরোনো শাসকেরাই নতুন মুখোশ পরে পুরোনো ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থাই বহাল রাখছে।একে বলা যায় প্রতিবিপ্লবকে (লিগ্যালাইজড কাউন্টার রেভল্যুশন) বৈধতা ও ন্যায্যতা দেওয়ার কৌশল। ফলে সংস্কারের নামে পুরোনো শাসকশ্রেণি ও শাসনকেই চিরস্থায়ী করার আয়োজন চলছে।কিন্তু জনগণ কি তা মেনে নেবে?
*মতামত লেখকের নিজস্ব