ইসরায়েলের রাষ্ট্রায়ত্ত অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘রাফায়েল’ সম্প্রতি একটি প্রোমোশনাল ভিডিও প্রকাশ করেছে। যেখানে তাদের তৈরি ‘স্পাইক ফায়ারফ্লাই’ ড্রোন গাজায় একজন ব্যক্তিকে অনুসরণ করে হত্যা করতে দেখা যায়। ভিডিওটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে এবং এটিকে সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধ হিসেবে অভিহিত করেছেন অনেক বিশেষজ্ঞ।
ভিডিওতে দেখা যায়, একটি ক্ষুদ্র কামিকাজে ড্রোন ধ্বংসস্তূপে ভরা গাজা শহরের একটি রাস্তার ওপর ভেসে রয়েছে।এরপর ড্রোনটি একজন হেঁটে যাওয়া ব্যক্তিকে শনাক্ত করে এবং তাকে লক্ষ্য করে আঘাত হানে। ভিডিওর শিরোনাম ছিল ‘স্পাইক ফায়ারলি ইন আরবান ওয়ারফেয়ার’ এবং এতে নাটকীয় সামরিক সঙ্গীতও যোগ করা হয়েছে।অন-স্ক্রিন টাইটেলে লেখা হয়, ‘ড্রোনটি লক্ষ্য শনাক্ত করে অনুসরণ করে এবং লক্ষ্যবস্তুকে শেষ করে।’ভিডিওতে দেখা যায়, ওই ব্যক্তি ড্রোন দেখতে পেয়ে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন।এরপর একটি বিস্ফোরণ ঘটে, যেখানে তাকে লক্ষ্য করে আঘাত হানা হয়। ভিডিওতে স্পষ্ট নয় ওই ব্যক্তি কোনো যোদ্ধা কি না। কারণ তিনি একা রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলেন এবং তার হাতে কোনো অস্ত্র ছিল না।ওপেন সোর্স বিশ্লেষক অ্যানো নিমো ভিডিওটি উত্তর গাজার আল-তাওয়াম এলাকায় তোলা বলে চিহ্নিত করেছেন।তিনি বলেন, স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে এটি সম্ভবত ২০২৪ সালের ৪ জুন থেকে ১ ডিসেম্বরের মধ্যে ধারণ করা হয়েছে।রাফায়েলের এক্স পোস্টে বলা হয়, ‘স্পাইক ফায়ারলি’-এর দুই বছর পূর্তিতে আমরা একটি নতুন নিখুঁততা যুগে প্রবেশ করেছি। এটি পরীক্ষিত, নির্ভরযোগ্য এবং কার্যকর।’ তাদের দাবি, জিপিএস জ্যামিং বা খারাপ আবহাওয়ার মধ্যেও এই ড্রোন নির্ভুলভাবে লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করতে সক্ষম।রাফায়েল জানায়, এই ড্রোনটি বিশেষভাবে ঘনবসতিপূর্ণ শহর এলাকায় ব্যবহারের জন্য তৈরি।যেখানে শত্রুপক্ষ আড়াল থেকে হামলা করে এবং নিরীহ সাধারণ মানুষ খুব কাছাকাছি অবস্থান করেন। কিন্তু এই ভিডিওতে এমন পরিস্থিতির কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। মিডলইস্ট আই রাফায়েল কম্পানির কাছে এ বিষয়ে মন্তব্য চাইলেও, এই প্রতিবেদন প্রকাশের সময় পর্যন্ত কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। ইসরায়েল বর্তমানে বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম অস্ত্র রপ্তানিকারক এবং তাদের অস্ত্র অন্তত ১৩০টি দেশে বিক্রি হয়েছে। গাজা ও পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রগুলোকে ‘ব্যাটলফিল্ড-টেস্টেড’ হিসেবে বাজারজাত করে ইসরায়েলি কম্পানিগুলো। এই ভিডিওকেও তেমন একটি বিপণন কৌশল হিসেবে দেখা হচ্ছে।রাফায়েল ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্রের সঙ্গে গঠিত হয় এবং তারা বর্তমানে সবচেয়ে বেশি পরিচিত আয়রন ডোম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার নির্মাতা হিসেবে। এ ছাড়া তারা বিভিন্ন নির্দেশিত ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণেও খ্যাত।এই কম্পানির বিপণনের ইতিহাস অনেকটাই ব্যতিক্রমী। ২০০৯ সালে তারা বলিউড স্টাইলের একটি মিউজিক ভিডিও তৈরি করে ভারতের বাজারে অস্ত্র বিক্রি করতে চেয়েছিল। ভিডিওতে একজন ইসরায়েলি পুরুষ ও একজন ভারতীয় নারীকে গান গাইতে দেখা যায়—‘তুমি আমার নিরাপত্তা, আমি তোমায় বিশ্বাস করি’। বিতর্কিত হলেও, ওই প্রচার অভিযান কয়েক বিলিয়ন ডলারের চুক্তি এনে দেয় বলে জানা গেছে।২০২৪ সালে রাফায়েলের বিক্রি বেড়ে ৪.৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়, যা আগের বছরের তুলনায় ২৭ শতাংশ বেশি। তাদের অর্ধেক রপ্তানি আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কাছে, যার মধ্যে ২০টি ন্যাটো সদস্য দেশ রয়েছে। কম্পানিটি উত্তর ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় নিয়োগদাতা এবং তাদের অফিস রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, আরব আমিরাতসহ ১০টি দেশে।এই ভিডিও নিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিশেষজ্ঞদের তীব্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। এসওএএস ইউনিভার্সিটির আইন বিশেষজ্ঞ নিমের সুলতানি বলেন, ‘ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, একজন নিরস্ত্র, নিরীহ ব্যক্তি রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন এবং কোনো সামরিক তৎপরতায় জড়িত নন। তাকে হত্যা করা একটি স্পষ্ট যুদ্ধাপরাধ।’তিনি আরো বলেন, ‘এই হত্যাকাণ্ডগুলো আসলে গণহত্যার অংশ এবং সেগুলোকে ‘জেনোসাইড কিলিংস’ বলা যায়।’ চতুর্থ জেনেভা কনভেনশনের ৩ নম্বর ধারা অনুযায়ী, যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত নয় এমন ব্যক্তিকে সব সময় মানবিকভাবে আচরণ করতে হবে এবং তাদের ওপর কোনো ধরনের হামলা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলে গণ্য হয়।রাফায়েলের স্পাইক মিসাইল ও অন্যান্য ড্রোন, বিশেষ করে অরবিটার ৪, ইসরায়েলের চলমান গাজা যুদ্ধেও ব্যবহার করা হয়েছে। এই ড্রোনটি প্রথম ব্যবহৃত হয় ৮ নভেম্বর ২০২৩ সালে। ২০২৫ সালের মার্চে রাফায়েলের মার্কিন শাখা ‘রাফায়েল সিস্টেমস গ্লোবাল সাসটেইনমেন্ট’ ঘোষণা দেয়, তারা মার্কিন সেনাবাহিনীর সঙ্গে স্পাইক ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে যৌথ উন্নয়ন চুক্তি করেছে।