যেসব কবি জন্মগ্রহণ করেন শব্দের অন্তস্তলে, যাদের অস্তিত্ব ধ্বনিময় নয়- নীরবতায় উজ্জ্বল, তারা কখনো কেবল কবি থাকেন না। তারা হয়ে ওঠেন সময়ের অন্তর্লীন অভিজ্ঞতা, ইতিহাসের অদৃশ্য শিরা-উপশিরা। আবুল হাসান ছিলেন তেমনই এক কবি, যিনি বাংলা কবিতায় প্রবেশ করেছিলেন এক তীব্র বিষণ্নতা, আত্মসংলাপ এবং মৃত্যুচেতনার দূত হয়ে। তিনি ছিলেন এক মহৎ অন্তর্জাগতিক চেতনাকে ধারণ করা হৃদয়-যেখান দিয়ে হেমন্তের বিষণ্ন হাওয়া বয়ে যেত, আর সেই হাওয়ার শব্দই হয়ে উঠতো তার কবিতা।
আবুল হাসানের কবিতার মধ্যে প্রবাহিত হয়েছে নিঃসঙ্গতা ও মৃত্যুর গভীর অনুভব। কিন্তু তা কোনো নিরাশার জগৎ নয়, বরং তা ছিল এক ধরনের দার্শনিক স্বীকারোক্তি, অস্তিত্বকে ছুঁয়ে দেখার নিরন্তর প্রচেষ্টা। তিনি বিশ্বাস করতেন, জীবনের সবচেয়ে প্রগাঢ় সত্য হলো তার ক্ষণস্থায়িত্ব। এ চেতনাই তার কাব্যভুবনের মূলে অবস্থিত।১৯৪৭ সালের ৪ আগস্ট, গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় কবি আবুল হাসানের জন্ম। বেড়ে ওঠা মঠবাড়িয়ার পিরোজপুরে। কৈশোরের দিনগুলো কেটেছে দক্ষিণ বাংলার নিস্তরঙ্গ অথচ বেদনাময় প্রকৃতির সান্নিধ্যে। আরমানিটোলা স্কুলের পাঠ শেষে এসএসসি, তারপর বরিশালের ঐতিহ্যবাহী ব্রজমোহন কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক পাঠ। এখানেই গড়ে ওঠে তার কবিচেতনা, শব্দের সঙ্গে তার নিঃশব্দ বোঝাপড়া। বিএম কলেজের ঐতিহ্যবাহী পাঠশালার ঘ্রাণ পাওয়া এ কবি সাহিত্য ও রাজনীতির উত্তাল সময়কে ধারণ করে নিজের অস্তিত্বকে গড়ে তুলেছিলেন এক নির্জন অভিমুখে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হলেও সে অধ্যয়ন অসম্পূর্ণ থাকে। এরপর তিনি যুক্ত হন সাংবাদিকতায়, কিন্তু তার আত্মা বাস করত কবিতার গর্ভগৃহে। যেখানে তিনি খুঁজতেন অস্তিত্বের গভীরতম প্রশ্ন- ভালোবাসা, শূন্যতা, মানুষ, মুক্তি এবং মৃত্যু।আবুল হাসানের কবিতা কেবল ভাষার নয়, বোধের শিল্প। তার কাব্যভাষা ছিল শহুরে ক্লান্তির সাথে গ্রামীণ নৈঃশব্দ্যের এক অদ্ভুত মিশ্রণ।তিনি লিখেন- ‘মানুষ চাঁদে গেল, আমি ভালোবাসা পেলুম/পৃথিবীতে তবু হানাহানি থামল না!এ উচ্চারণে ধরা পড়ে এক নিরপেক্ষ অথচ মর্মান্তিক বীক্ষণ- যেখানে ব্যক্তি অনুভূতির সঙ্গে সমাজ-সভ্যতার নৈতিক দীনতা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তিনি ভালোবাসার কবি, তবে তা উদযাপনমূলক নয়; বরং বিষণ্ন আত্মোপলব্ধির, যেখানে প্রেম হয়ে ওঠে সভ্যতার ব্যর্থতার বিপরীতে একটি বিক্ষিপ্ত আশ্রয়।তার কবিতা আত্মজৈবনিক হয়েও কখনো আত্মকেন্দ্রিক নয়। তিনি গভীরভাবে সামাজিক কিন্তু তা স্লোগানধর্মী নয়- বরং অন্তর্গত ও দার্শনিক। তার এ দর্শন সবচেয়ে বেশি প্রকাশ পেয়েছে মৃত্যুচেতনায়। তিনি বলেন, ‘মৃত্যু আমাকে নেবে, জাতিসংঘ আমাকে নেবে না।’এ স্ববিরোধপূর্ণ অথচ তীব্র বাক্যবন্ধে আমরা দেখতে পাই, কীভাবে একজন কবি নিজের মৃত্যুকেও রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক গৎবাঁধা কাঠামোর বাইরে দাঁড় করিয়ে দেন। মৃত্যু তার কাছে দুঃখের বিষয় নয়, বরং আত্মপরিচয়ের চূড়ান্ত প্রকাশ।তার কাব্যগ্রন্থ ‘যে তুমি হরণ করো, পৃথক পালঙ্ক’ ও ‘রাজা যায় রাজা আসে’ এ ত্রয়ীর মধ্যে আমরা পাই এক কবির আত্মার পর্যায়ক্রমিক বিকাশ। প্রথমে প্রেম ও বিচ্ছিন্নতা, পরে সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তা এবং শেষে চিরন্তন প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি দাঁড়ানো। এ দাঁড়ানো কখনো রক্তগরম করে না বরং হৃদয়কে প্রশান্ত করে তোলে।মুক্তিযুদ্ধ তার কাব্যচেতনায় রয়েছে গভীরভাবে, কিন্তু কখনো বাহ্যিক ঢাক-ঢোল পিটিয়ে নয়। তিনি যুদ্ধোত্তর মানবিক চেতনার সংকট নিয়েই বেশি প্রশ্ন তোলেন। তিনি লিখেছেন- ‘সুধীবৃন্দ ক্ষান্ত হোন, গোলাপ ফুলের মতো শান্ত হোন, কি লাভ যুদ্ধ করে? শত্রুতায় কি লাভ বলুন?’এখানে যুদ্ধের অন্তঃসারশূন্যতা নয়, বরং তার অন্তর্লীন মানবিকতাবোধ, পুনর্গঠনের জরুরি আহ্বান উঠে আসে। আবুল হাসানকে তাই শুধু কবি বলা চলে না। তিনি ছিলেন এক দর্শন- যেখানে শব্দ, নিঃশব্দতা, প্রেম, বেদনা এবং মৃত্যু এক মহাকাব্যিক দোলাচলে বাঁধা পড়ে।তার জীবন ছিল সংক্ষিপ্ত, মাত্র ২৮ বছর। কিন্তু এ স্বল্পায়ু জীবনেই তিনি নির্মাণ করেছেন এক মহাকাব্যিক নিঃসঙ্গতার রূপকথা। ১৯৭৫ সালের ২৬ নভেম্বর তিনি চলে যান, কিন্তু রেখে যান যে কবিতাগুলো, সেগুলো আজও আমাদের অবচেতনকে নাড়া দেয়। সে কবিতায় কেবল ভাষা নয়, আত্মাও কথা বলে।আজ তার জন্মদিনে যখন আমরা আবুল হাসানকে স্মরণ করি, তখন তাকে কেবল শ্রদ্ধায় নয়, এক গূঢ় দার্শনিক ঋণে স্মরণ করি। যে ঋণ শব্দ দিয়ে শোধ হয় না- শুধু নীরব পাঠে, গভীর পাঠে ধরা পড়ে।