এভাবে পাঁচ বছরে পাঁচজন এমডি দায়িত্ব পালন করেছেন বিমানে। এর মধ্যে একজনের মেয়াদ ছিল মাত্র পাঁচ মাস। বিমানের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে বসে কিছু বোঝার আগেই বিদায় নিতে হয়। এভাবে ৫৪ বছর বয়সী বিমানে এমডির দায়িত্ব পালন করেছেন ৪৭ জন। বিমান বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হওয়ায় এর সঙ্গে লাভ-ক্ষতি জড়িত। হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ এখানে। অথচ এমডি হিসেবে এখানে পাঠানো হচ্ছে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের। অ্যাভিয়েশন খাতে চাকরি করতে গেলে একজন সিইওকে অনেক কমপ্লায়েন্স ইস্যু জানতে হয়। আন্তর্জাতিক সিভিল অ্যাভিয়েশন সংস্থার (আইকাও) কিছু কমপ্লায়েন্স আছে, বেবিচকের কিছু আছে; যে দেশের সঙ্গে ফ্লাইট পরিচালনা করতে যাবেন সে দেশের সিভিল অ্যাভিয়েশনের কিছু কমপ্লায়েন্স মানতে হয়। আন্তর্জাতিক অনেক রুল জানতে হয়। এসব একজন লোক একদিনে শিখতে পারেন না। একজন এমডির যদি এসব আগে থেকে জানা না থাকে তার জন্য বিমানের মতো প্রতিষ্ঠান চালানো অনেক কঠিন। এভাবে তিনি নিজ প্রতিষ্ঠানকে নেতৃত্ব দিতে পারবেন না।
বিমানে কখনো পেশাদার এমডি ছিল না বিষয়টি এমন নয়। প্রশাসন ক্যাডার থেকে এমডি হয়েও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন ড. এমএ মোমেন। মোমেন যখন বিমানের এমডি ছিলেন, তখন তিনি বিমানের বড় বড় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে অপসারণ করেন। বিমানকে বাণিজ্যিকীকরণের লক্ষ্যে পাবলিক লিমিটেড কম্পানিতে রূপান্তর করেন তিনিই। বিমানকে দুর্নীতিমুক্ত করতে স্বেচ্ছা অবসরের (ভিআরএস) মাধ্যমে ২ হাজার ৮০১ জনকে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকে পাঠান। তার আমলেই ১০টি আধুনিক উড়োজাহাজ কেনার চুক্তি করে বিমান।
পর্ষদ চেয়ারম্যান হিসেবে বর্তমান সরকারের আমলে সফল না হতে পারলেও মুয়ীদ চৌধুরী যখন বিমানের এমডি ছিলেন, তখন সংস্থাটি ভালো চলছিল। তিনি বিমানের কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নির্মাণ করেছেন। উড়োজাহাজ ক্রয় ও মেরামতে স্বচ্ছতা আনেন। তার সময়ই সবচেয়ে বেশি গন্তব্যে যায় বিমান। তার সময়েই বিমান প্রথম লাভের মুখ দেখে। বিমানের প্রথম বিদেশি এমডি ছিলেন কেভিন জন স্টিল। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের সাবেক এ কর্মকর্তা ২০১৩ সালের ১৮ মার্চ যোগ দেন। তিনি ছিলেন অ্যাভিয়েশন শিল্পে ৩০ বছরের বেশি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। বিমানের আগে কেভিন ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের সিঙ্গাপুর, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত, পাকিস্তান ও সৌদি আরব স্টেশনে কাজ করেছেন। তিনি ২০১০ সাল থেকে এরিক এয়ারের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট (বাণিজ্য) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি চার্টার্ড ইনস্টিটিউট অব ট্রান্সপোর্টের একজন ফেলো ও সদস্য এবং বিপণন ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটেরও একজন সদস্য। কর্মজীবনের বিভিন্ন সময় বাণিজ্যিক এয়ারলাইনসে বিক্রয় ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা, রুট ডেভেলপমেন্ট, ব্যবসায় সম্প্রসারণ, বিমানবন্দর এবং বিতরণ ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করেছেন তিনি। ইংরেজি ছাড়াও মান্দারিন (চীনা), ফরাসি এবং জার্মান ভাষায় পারদর্শী কেভিন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে এমডি পদে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বিমান। ওই সময় দেশি-বিদেশি মিলিয়ে ৪২ জনের আবেদন জমা হয়েছিল। এ তালিকা থেকে সাবেক বিমান সচিব আতহারুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি কমিটি যাচাই-বাছাই শেষে আটজনের সংক্ষিপ্ত তালিকা করে, যাতে জায়গা পাওয়া সবাই ছিলেন বিদেশি। এই প্রক্রিয়ায় নিয়োগ পান কেভিন স্টিল। কেভিন বিমানকে দুই বছরের মধ্যে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার অঙ্গীকার করেছিলেন। তার বাস্তবায়ন তিনি শুরু করেছিলেন টিকিট বিক্রির সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে। পাশাপাশি বিমানের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। কিন্তু এক বছরের মাথায় তাকে বিদায় নিতে হয়।
কেভিন স্টিলের পদত্যাগের পর বিমানের এমডি ছিলেন কাইল হেউড। তিনিও ব্রিটিশ নাগরিক ছিলেন। বিমানে যোগ দেওয়ার আগে তিনি পূর্ব আফ্রিকার দুটি বিমান সংস্থার এমডি ছিলেন। একসময় তিনি ব্রিটিশ এয়ারওয়েজেও চাকরি করেছেন। তিনি সেখানে ব্যবস্থাপক (ম্যানেজার) পদে ছিলেন। এরপর তিনি ইতিহাদ, এমিরেটস, এয়ার আরাবিয়া, গালফ এয়ারসহ বিমান সংস্থায় চাকরি করেন। তিনিও দায়িত্ব নিয়ে বিমানের প্রশাসনিক সংস্কার ও দক্ষ জনবলের দিকে মনোযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু হেউডও দায়িত্ব ছাড়তে বাধ্য হন।
একটি এয়ারলাইনসে অভিজ্ঞ ও লম্বা সময়ের জন্য এমডি নিয়োগ দেওয়ার কথা বলেছেন বিমানের সাবেক পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ও অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম। তিনি বলেন, ‘একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে স্বল্প সময়ের মধ্যে এমডি বদলি হওয়াটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। সারা বিশ্বে অ্যাভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি উন্নতি করছে। আমাদেরও সে পথে হাঁটতে হবে। আমাদের এই মুহূর্তে প্রতিযোগী এয়ারলাইনসগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতার পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। বিমানের সামনে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী। কাতার এয়ারওয়েজ, এমিরেটসের মতো মেগা ক্যারিয়ারগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় যেতে হলে বিমানের শুধু বেশি বেশি এয়ারক্রাফট কিনলেই চলবে না। বেশি বেশি হিউম্যান রিসোর্স লাগবে। একটি প্রতিষ্ঠানের হিউম্যান রিসোর্সের টিম লিডার হিসেবে এমডিকে দক্ষ হতে হবে এবং তার স্বপদে দীর্ঘ সময় থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। কেউ যদি এক বছরের জন্য এসে আবার চলে যান, ওই এক বছরে তিনি যে দক্ষতা অর্জন করলেন, সেটি তো আর কাজে আসল না।’