সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার বুড়ি পোতাজিয়া এলাকায় রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবিত স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ পরিকল্পনা বাতিলের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), চলনবিল রক্ষা আন্দোলনসহ ২২টি পরিবেশবাদী ও সামাজিক সংগঠন। সংগঠনগুলোর অভিযোগ, একশ একর জমি ভরাট করে এই স্থানে ক্যাম্পাস নির্মাণ চলনবিলের প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহ ও বাস্তুতন্ত্রকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, যা স্থানীয় কৃষি, মৎস্যচাষ, জীববৈচিত্র্য ও বন্যার ধরন পরিবর্তনসহ এক কোটি মানুষের জীবন-জীবিকায় সরাসরি প্রভাব ফেলবে।বৃহস্পতিবার (২৮ আগস্ট) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানানো হয়। সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সভাপতি অধ্যাপক নুর মোহাম্মদ তালুকদারের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক আলমগীর করিরের সঞ্চালনায় প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন চলনবিল ও বড়াল রক্ষা আন্দোলনে সদস্যসচিব এস এম মিজানুর রহমান।সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নদী ও জলাভূমিকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। তাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস যদি চলনবিলের মুখ বন্ধ করে নির্মিত হয়, তা হবে নিতান্তই দুঃখজনক। প্রস্তাবিত ক্যাম্পাস নির্মাণ পরিকল্পনা ২০০০ সালের জলাশয় রক্ষা আইন, ২০১৩ সালের পানি আইন এবং দেশের উচ্চ ও সর্বোচ্চ আদালতের নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে স্বীকৃতির রায়ের পরিপন্থী। পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্তকারী স্থাপনা নির্মাণ এই আইন ও রায়ের স্পষ্ট লঙ্ঘন।আরো বলা হয়, প্রস্তাবিত স্থানে এই নির্মাণকাজ হলে বাঘাবাড়ী নৌবন্দরের কার্যক্রম হুমকির মুখে পড়বে। বর্তমানে বড়াল, গোহালা নদীসহ আশপাশের জলপথ দিয়ে দুধ ও কৃষিপণ্য বাঘাবাড়ী মিল্কভিটা এবং অন্যান্য স্থানে পৌঁছে। এ ছাড়া হুড়াসাগর নদীপথ দিয়ে পেট্রোল ও ডিজেল বন্দরটিতে আসে, যা পরবর্তীতে উত্তরবঙ্গে সরবরাহ করা হয়। বুড়ি পোতাজিয়ায় পানি প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হলে এই গুরুত্বপূর্ণ নৌপথের স্থায়িত্ব ও কার্যকারিতা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হবে।তাই পরিবেশের ক্ষতি না করে বিকল্প স্থানে আরো উন্নত নকশার ক্যাম্পাস নির্মাণের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার জন্য রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন, শিক্ষকমণ্ডলী ও শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।সংগঠনগুলো বিকল্প হিসেবে শাহজাদপুরের রবীন্দ্রনাথের কাচারীবাড়ির চারপাশে ক্যাম্পাস নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছে। তাদের মতে, জমি-স্বল্প বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিশাল জমি দখল না করে স্বল্প জমিতে বহুতল ভবন নির্মাণের মাধ্যমে আধুনিক ক্যাম্পাস গড়ে তোলা সম্ভব। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় মাত্র ৫ একর জমিতে সুন্দর স্থায়ী ক্যাম্পাস গড়ে তুলেছে। এ ছাড়া দ্বিতীয় বিকল্প হিসেবে সিরাজগঞ্জ অর্থনৈতিক অঞ্চলের একটি অংশ ব্যবহারের প্রস্তাব করা হয়েছে।যেখানে এক হাজার ১৫৬ একর জমি রয়েছে এবং যার অংশবিশেষ ক্যাম্পাসের জন্য বরাদ্দ করলে কোনো ক্ষতি হবে না। বরং সেটা অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য হবে বলে মনে করেন তারা।মূল বক্তব্যে বলা হয়, চলনবিল দেশের বৃহত্তম মিঠাপানির জলাভূমি, যা ৬টি জেলা ও ৩৬টি উপজেলা জুড়ে বিস্তৃত এবং আয়তন প্রায় এক হাজার ৮৮ বর্গকিলোমিটার। বর্ষাকালে পদ্মা ও যমুনার কূল উপচানো পানি এই বিলে জমা হয়, যা বন্যার প্রকোপ কমায় এবং শুষ্ক মৌসুমে আবার নদীতে ফিরে গিয়ে প্রবাহ বৃদ্ধি করে। বিলের ভেতরে রয়েছে ৪৭টি নদী, ১৬৩টি বিল, ৩০০টির বেশি খাল, এক লাখ ২০ হাজার পুকুর এবং কয়েকটি বড় পাথার, যা মিলে একটি অনন্য জলজ ও স্থলজ বাস্তুতন্ত্র গড়ে তুলেছে। এখানে প্রায় ১০৫ প্রজাতির দেশি মাছ, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৭ প্রজাতির উভচর, ৩৪ প্রজাতির পাখি এবং অসংখ্য উদ্ভিদ ও প্রাণীর বসবাস।আরো বলা হয়, বুড়ি পোতাজিয়া চলনবিলের যমুনার সঙ্গে একমাত্র পতনমুখ। এই স্থানে ১০০ একর জমি ৯ থেকে ১৪ মিটার উঁচু করতে প্রায় ৩.৬ মিলিয়ন ঘনমিটার বালু ভরাটের পরিকল্পনা রয়েছে, যা পানির স্বাভাবিক প্রবাহে বিশাল প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। যমুনার পানি অবাধে চলনবিলে প্রবেশ করতে না পারলে বিলের বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস হবে, নদী-খাল শুকিয়ে যাবে, দেশীয় মাছের প্রজনন ব্যাহত হবে এবং মৌসুমি বন্যার ধরন পরিবর্তিত হবে। বর্ষাকালে কিছু পানি জমলেও শুষ্ক মৌসুমে যমুনায় ফিরতে পারবে না, ফলে অবাঞ্ছিত জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে কৃষিজমি, বসতি ও অবকাঠামো দীর্ঘ সময় পানির নিচে ডুবে থাকবে। এতে আশপাশের এলাকার ফসল চক্র বিপর্যস্ত হবে।
এ ক্যাটাগরির আরো নিউজ..