وَ مَا جَعَلَ عَلَیۡكُمۡ فِی الدِّیۡنِ مِنۡ حَرَجٍ ؕ مِلَّۃَ اَبِیۡكُمۡ اِبۡرٰهِیۡمَ ؕ هُوَ سَمّٰىكُمُ الۡمُسۡلِمِیۡنَ ۬ۙ
‘তিনি তোমাদের জন্য দ্বিনে কোনো সংকীর্ণতা আরোপ করেননি। এটি তোমাদের পিতা ইবরাহিম (আ.)-এর দ্বিন, তিনি তোমাদের মুসলমান নামকরণ করেছেন।’ (সুরা : হজ, আয়াত : ৭৮)
অন্য আয়াতে এসেছে,
یُرِیۡدُ اللّٰهُ بِكُمُ الۡیُسۡرَ وَ لَا یُرِیۡدُ بِكُمُ الۡعُسۡرَ ۫
‘আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান এবং কঠিন করতে চান না।
অন্য এক আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন,
ا یُكَلِّفُ اللّٰهُ نَفۡسًا اِلَّا وُسۡعَهَا ؕ
‘আল্লাহ তাআলা কারো ওপর তার সাধ্যের বাইরে বোঝা চাপিয়ে দেন না। (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ২৮৬)
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন,
إِنَّ الدِّينَ يُسْرٌ، وَلَنْ يُشَادَّ الدِّينَ أَحَدٌ إِلاَّ غَلَبَهُ
‘নিশ্চয়ই দ্বিন সহজ। দ্বিন নিয়ে যে বাড়াবাড়ি করে দ্বিন তার ওপর জয়ী হয়।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩৯)
আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন,
“ يَسِّرُوا وَلاَ تُعَسِّرُوا، وَبَشِّرُوا وَلاَ تُنَفِّرُوا ”
‘মানুষের জন্য কাজ সহজ করো, কঠিন কোরো না সুসংবাদ দাও, আতঙ্কিত কোরো না।
শরিয়তে সহজীকরণের প্রথম ও সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত হলো তাওবার দরজা সর্বদা উন্মুক্ত রাখা। পবিত্র কোরআনে এসেছে :
وَ هُوَ الَّذِیۡ یَقۡبَلُ التَّوۡبَۃَ عَنۡ عِبَادِهٖ وَ یَعۡفُوۡا عَنِ السَّیِّاٰتِ وَ یَعۡلَمُ مَا تَفۡعَلُوۡنَ ﴿ۙ۲۵﴾
‘তিনিই তাঁর বান্দাদের তাওবা কবুল করেন, সব পাপ ক্ষমা করেন এবং তোমাদের যাবতীয় কৃতকর্ম সম্পর্কে অবগত।’ (সুরা : শুয়ারা, আয়াত : ২৫)
এভাবেই আল্লাহ তাআলা বান্দার সব ক্ষেত্রে সহজীকরণের অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। যেমন—
রোজার সহজীকরণ : মাগরিব থেকে ফজর পর্যন্ত খাওয়াদাওয়া করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
অসুস্থ ও ভ্রমণকারীর জন্য সহজ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন :
فَمَنۡ كَانَ مِنۡكُمۡ مَّرِیۡضًا اَوۡ عَلٰی سَفَرٍ فَعِدَّۃٌ مِّنۡ اَیَّامٍ اُخَرَ ؕ
‘তোমাদের মধ্যে যে অসুস্থ বা ভ্রমণরত, সে অন্য দিনে সমানসংখ্যক রোজা পূরণ করবে।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১৮৪)
একইভাবে গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারী মহিলার জন্যও রোজা ভাঙার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
وَ اِذَا ضَرَبۡتُمۡ فِی الۡاَرۡضِ فَلَیۡسَ عَلَیۡكُمۡ جُنَاحٌ اَنۡ تَقۡصُرُوۡا مِنَ الصَّلٰوۃِ ٭ۖ
‘যদি তোমরা ভ্রমণরত থাকো, তবে নামাজ সংক্ষিপ্ত করতে কোনো দোষ নেই।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ১০১)
২. ভুলে নামাজ ছুটে গেলে পরে আদায় করা : রাসুল (সা.) বলেন,
“ مَنْ نَسِيَ صَلاَةً فَلْيُصَلِّ إِذَا ذَكَرَهَا، لاَ كَفَّارَةَ لَهَا إِلاَّ ذَلِكَ ”
‘যে ব্যক্তি নামাজ ভুলে যায়, সে যেন স্মরণ হওয়ার পরই তা আদায় করে। আর এর কাফফারা একমাত্র সেই নামাজ আদায় করাই।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৯৭)
ভুলের ক্ষেত্রে সহজীকরণ : রাসুল (সা.) বলেন,
إِنَّ اللهَ وَضَعَ عَنْ أُمَّتِي الْخَطَأَ وَالنِّسْيَانَ وَمَا اسْتُكْرِهُوا عَلَيْهِ
‘আল্লাহ আমার উম্মতের ভুল, ভ্রমণ এবং ভুলে যাওয়ার কারণে সংঘটিত কাজগুলো ক্ষমা করে দিয়েছেন।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২০৪৫)
অজ্ঞতার ক্ষেত্রে সহজীকরণ : যে ব্যক্তি অজ্ঞতাবশত ইহরামের সময় কোনো নিষিদ্ধ কাজ করে, সে গুনাহগার নয়। এর প্রমাণ—একবার একজন মানুষ ইহরাম বেঁধে সুগন্ধি ব্যবহার করেছিলেন। তখন নবী করিম (সা.) তাকে বলেন,
فَقَالَ أَمَّا الطِّيْبُ الَّذِيْ بِكَ فَاغْسِلْهُ ثَلَاثَ مَرَّاتٍ وَأَمَّا الْجُبَّةُ فَانْزِعْهَا
‘তোমার শরীর থেকে সুগন্ধি তিনবার ধুয়ে ফেলো এবং চাদর খুলে ফেলো।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৪৩২৯)
নারীর জন্য সহজীকরণ : ফাতিমা বিনতে আবি হুবাইশ (রা.) মাসিক সংক্রান্ত সমস্যায় ভুগছিলেন। তখন নবী করিম (সা.) তাঁকে বলেন,
فَإِذَا أَقْبَلَتْ حَيْضَتُكِ فَدَعِي الصَّلاَةَ،
‘যখন তোমার ঋতুস্রাব শুরু হয়, তখন নামাজ ত্যাগ কোরো।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২২৮)
বল প্রয়োগের কারণে সহজীকরণ : রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ আমার উম্মতের ভুল, ভুলে যাওয়া এবং যেসব কাজ তারা বাধ্য হয়ে করেছে—সব ক্ষমা করে দিয়েছেন।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৪৫)
অতএব, একজন মুসলিম যদি ঈমান দ্বারা অন্তর দৃঢ় হওয়ার পরও জোরপূর্বক কোনো কিছু বলতে বা করতে বাধ্য হয়, তবে তার জন্য কোনো ক্ষতি নেই।
পবিত্রতার ক্ষেত্রে সহজীকরণ : যদি জুতায় নাপাক কিছু লেগে যায়, তবে মাটিতে মুছে তা পবিত্র করা যায়। নবী করিম (সা.) বলেছেন,
إِذَا جَاءَ أَحَدُكُمْ إِلَى الْمَسْجِدِ فَلْيَنْظُرْ فَإِنْ رَأَى فِي نَعْلَيْهِ قَذَرًا أَوْ أَذًى فَلْيَمْسَحْهُ وَلْيُصَلِّ فِيهِمَا
‘যখন তোমাদের কেউ মসজিদে আসে, তখন সে যেন দেখে নেয়। যদি জুতায় নোংরা কিছু দেখে, তবে তা মুছে ফেলে নামাজ পড়ুক।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৬৫০)
আবার কেউ যদি অসুস্থতার কারণে কিংবা পানি না পাওয়ার কারণে অজু করতে অক্ষম হয়, তবে তার জন্য তায়াম্মুম করা বৈধ। আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَ اِنۡ كُنۡتُمۡ مَّرۡضٰۤی اَوۡ عَلٰی سَفَرٍ اَوۡ جَآءَ اَحَدٌ مِّنۡكُمۡ مِّنَ الۡغَآئِطِ اَوۡ لٰمَسۡتُمُ النِّسَآءَ فَلَمۡ تَجِدُوۡا مَآءً فَتَیَمَّمُوۡا صَعِیۡدًا طَیِّبًا فَامۡسَحُوۡا بِوُجُوۡهِكُمۡ وَ اَیۡدِیۡكُمۡ مِّنۡهُ ؕ مَا یُرِیۡدُ اللّٰهُ لِیَجۡعَلَ عَلَیۡكُمۡ مِّنۡ حَرَجٍ وَّ لٰكِنۡ یُّرِیۡدُ لِیُطَهِّرَكُمۡ
‘আর যদি তোমরা অসুস্থ হও অথবা সফরে থাকো, অথবা তোমাদের কেউ পায়খানা থেকে আসে কিংবা নারীদের সাথে মিলন করো এবং পানি না পাও, তবে পবিত্র মাটি দিয়ে তায়াম্মুম করো। আল্লাহ তোমাদের জন্য কষ্ট চান না, বরং তোমাদেরকে পবিত্র করতে চান।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৬)
যারা অসুস্থতা, আঘাত, তীব্র ঠাণ্ডা বা পানির অনুপস্থিতির কারণে অজু বা গোসল করতে পারে না, তাদের জন্য ইসলামে সহজ বিকল্প ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সেটি হলো তায়াম্মুম। আল্লাহ বলেন :
وَ لَا تَقۡتُلُوۡۤا اَنۡفُسَكُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰهَ كَانَ بِكُمۡ رَحِیۡمًا
‘তোমরা নিজেদের হত্যা কোরো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ২৯)
ভয়ের সময় সহজীকরণ : যুদ্ধ, দস্যুদের আক্রমণ, বন্যপ্রাণীর ভয়, বন্যা ইত্যাদি পরিস্থিতিতে নামাজ সংক্ষিপ্ত ও ভিন্নভাবে আদায় করার অনুমতি রয়েছে। একে বলা হয় সালাতুল খাওফ (ভয়ের নামাজ)। আল্লাহ বলেন,
وَ اِذَا ضَرَبۡتُمۡ فِی الۡاَرۡضِ فَلَیۡسَ عَلَیۡكُمۡ جُنَاحٌ اَنۡ تَقۡصُرُوۡا مِنَ الصَّلٰوۃِ ٭ۖ اِنۡ خِفۡتُمۡ اَنۡ یَّفۡتِنَكُمُ الَّذِیۡنَ كَفَرُوۡا ؕ
‘যখন তোমরা ভ্রমণে থাকো, তখন সালাত সংক্ষিপ্ত করতে তোমাদের কোনো দোষ নেই, যদি তোমরা আশঙ্কা করো যে কাফিররা তোমাদের ক্ষতি করবে।’ (সুরা : নিসা. আয়াত : ১০১)
নামাজের ক্ষেত্রে সাধারণ সহজীকরণ : ইসলাম-পূর্ববর্তী জাতিদের নামাজ শুধু উপাসনালয় বা মাঠেই আদায় করার অনুমতি ছিল। কিন্তু রাসুল (সা.) বলেছেন,
“ أُعْطِيتُ خَمْسًا لَمْ يُعْطَهُنَّ أَحَدٌ قَبْلِي نُصِرْتُ بِالرُّعْبِ مَسِيرَةَ شَهْرٍ، وَجُعِلَتْ لِيَ الأَرْضُ مَسْجِدًا وَطَهُورًا، فَأَيُّمَا رَجُلٍ مِنْ أُمَّتِي أَدْرَكَتْهُ الصَّلاَةُ فَلْيُصَلِّ، وَأُحِلَّتْ لِيَ الْمَغَانِمُ وَلَمْ تَحِلَّ لأَحَدٍ قَبْلِي، وَأُعْطِيتُ الشَّفَاعَةَ، وَكَانَ النَّبِيُّ يُبْعَثُ إِلَى قَوْمِهِ خَاصَّةً، وَبُعِثْتُ إِلَى النَّاسِ عَامَّةً ”.
‘আমাকে পাঁচটি বিশেষ জিনিস দেওয়া হয়েছে, যা আমার আগে কাউকে দেওয়া হয়নি—
১. এক মাস দূরত্ব থেকেও আমার শত্রুর মনে আতঙ্ক নিক্ষেপ করা হয়েছে।
২. পুরো পৃথিবী আমার জন্য পবিত্র ও সিজদার স্থান করা হয়েছে। তাই যেখানে সালাতের সময় হবে, সেখানেই মুসলিম নামাজ আদায় করতে পারবে।
৩. যুদ্ধলব্ধ সম্পদ আমার জন্য হালাল করা হয়েছে, যা আমার আগে কারো জন্য হালাল করা হয়নি।
৪. আমাকে সুপারিশের অধিকার দেওয়া হয়েছে।
৫. আমার আগে প্রত্যেক নবীকে শুধু তাঁর জাতির জন্য পাঠানো হতো, কিন্তু আমাকে সমগ্র মানবজাতির জন্য পাঠানো হয়েছে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩৩৫)
জাকাত প্রদানে সহজীকরণ : ১. ইসলামের ফরজ একটি ইবাদত হলো জাকাত আর এর সহজীকরণের দিক হলো—জাকাত শুধু বছরে একবার আদায় করা ফরজ, সেটিও সম্পদের ওপর পূর্ণ এক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর। এতে ধনীদের ওপর বাড়তি চাপ নেই, আবার গরিবদের অধিকারও নিশ্চিত হয়।
২. ইসলামে জাকাত ফরজ করা হয়েছে ধনীদের সম্পদের ওপর, তবে এর হার খুবই সামান্য। জাকাতের এই পরিমাণ এতই কম যে জাকাত প্রদানকারীর সম্পদের ওপর তার কোনো উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়ে না, আবার প্রাপকের কাছেও এটি ভারী হয়ে ওঠে না, বরং সমাজের ভারসাম্য রক্ষার জন্য এটি এক মহান উপায়।
হজের সময় সহজীকরণ : হজের ক্ষেত্রে মুসলমানদের জন্য আল্লাহ তিন ধরনের আচারের মধ্যে যেকোনো একটিকে বেছে নেওয়ার সুযোগ দিয়েছেন—১. তামাত্ত, ২. কিরান, ৩. ইফরাদ।
আবার ঈদের দিনে তিনটি প্রধান কাজের মধ্যে সহজতর ক্রম নির্ধারণ করা হয়েছে—১. জামারাতে পাথর নিক্ষেপ করা, ২. মাথা মুণ্ডন করা বা চুল ছাঁটা, ৩. কাবাগৃহ তাওয়াফ করা। এই ক্রমানুসারে হজ পালন করলে হাজিদের জন্য ভিড়, যাতায়াত ও ভ্রমণের কষ্ট অনেকাংশে লাঘব হয়।
লেনদেনে সহজীকরণ : ইসলামের সহজীকরণ শুধু ঈমান, আকিদা ও ইবাদতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং মানুষের দৈনন্দিন লেনদেনেও এর নজির আছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প, কৃষি, শিক্ষা—সব ক্ষেত্রেই সহজ লেনদেন অন্তর্ভুক্ত। আর যেহেতু লেনদেনে অর্থ প্রধান ভূমিকা পালন করে, তাই এতে মানুষের ভুল ও সীমা লঙ্ঘনের আশঙ্কাও বেশি থাকে। তাই কোরআন ও হাদিসে লেনদেনে নম্রতা ও সহনশীলতার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। নবী করিম (সা.) বলেছেন,
رَحِمَ اللهُ رَجُلاً سَمْحًا إِذَا بَاعَ وَإِذَا اشْتَرَى وَإِذَا اقْتَضَى
‘আল্লাহ সেই ব্যক্তির প্রতি রহম করুন, যে কেনাবেচা ও পাওনা আদায়ের সময় নম্রতা ও সহনশীলতা অবলম্বন করে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২০৭৬)