রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান ও বনানীতে ১৯ এপ্রিল থেকে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ায় সেখানকার চালকদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করে। ২১ এপ্রিল সকাল থেকে ওই এলাকায় উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। শেষে সেটা রূপ নেয় সংঘর্ষে। বনানীর ১১ নম্বর রোডে পেডালচালিত দুজন রিকশাচালককে লেকে ফেলে দেওয়ার ঘটনাও ঘটে। এর পর থেকে অবৈধ এসব বাহন গুলশান-বনানীর সব সড়কে প্রকাশ্যে চলতে শুরু করে।গত ১৩ মে আবারও কঠোর হয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। পুলিশের সহায়তায় অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধে অভিযান চালানো হয় মোহাম্মদপুর, আসাদগেটসহ কিছু এলাকায়।ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ‘এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে এই ব্যাটারিচালিত রিকশার কারণে। এতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নারী ও শিশুরা। এসব অবৈধ রিকশা কোনো নীতিমালা বা যাত্রীদের নিরাপত্তার কথা মাথায় না রেখেই তৈরি করা হয়েছে। ফলে অনিয়ন্ত্রিত গতির কারণে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা।’তিনি আরো বলেন, ‘দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ও সড়কে গণপরিবহন চলাচলে শৃঙ্খলা ফেরাতে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। বুয়েটের সহায়তায় এরই মধ্যে ব্যাটারিচালিত নিরাপদ রিকশার নকশা প্রস্তুত করে কয়েকটি কম্পানিকে প্রস্তুতের জন্য অনুমতি দিয়েছে।’ঝুঁকিপূর্ণ বাহনটি তৈরি হয় যেখানে : ব্যাটারিচালিত রিকশার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এই অবৈধ বাহনটি নির্মাণ ও সংযোজন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে পুরান ঢাকা, কামরাঙ্গীর চর, মিরপুর, গাবতলী, মোহাম্মদপুর ও যাত্রাবাড়ী এলাকায় ছোট ছোট ওয়ার্কশপে ব্যাটারিচালিত রিকশা তৈরি ও রূপান্তর করা হচ্ছে। এসব ওয়ার্কশপে সাধারণত সাইকেল বা রিকশার ফ্রেমে ব্যাটারি ও মোটর সংযোজন করে ব্যাটারিচালিত রিকশা তৈরি করা হয়। এগুলোর বেশির ভাগ নিরাপত্তার মানদণ্ড অনুসরণ না করায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে চলেছে।পুরান ঢাকার কামরাঙ্গীর চর এলাকার একটি কারখানার কারিগর ইব্রাহিম মিয়া। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘আমাদের গ্যারেজ থেকে প্রতিদিন ৪-৫টা রিকশা ডেলিভারি দিই। কেউ অর্ডার করলেই আমরা কাজ শুরু করি। রিকশার বডি আমরা আগে কিছু বানিয়ে রাখি, যাতে চাইলে দ্রুত দেওয়া যায়। খরচও কম। ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকায় একটা রিকশা হয়ে যায়।’
লালবাগের শহীদনগর ৭ নম্বর গলির গ্যারেজে কাজ করেন ওয়াশিউর রহমান। তিনি বলেন, ‘রিকশার উপকরণ আমরা সংগ্রহ করি খোলাবাজার থেকে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে মোটর, হর্ন, ব্রেক সিস্টেম ইত্যাদি। এসব দেশের বাইরে থেকে আনতে হয়। আর চাকা, সিট, রিকশার বডি—এসব লোকাল বিভিন্ন দোকানে পাওয়া যায়।’বন্ধের উদ্যোগে সরকারের সফলতা মিলছে না : যানজট ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি এড়াতে অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধে সরকার কয়েকবার উদ্যোগ নিয়েও সফল হয়নি। মালিকদের প্ররোচনায় চালকদের প্রতিবাদের মুখে প্রতিবারই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে সরকার। এতে প্রতিদিন শুধু রাজধানীতেই তৈরি হচ্ছে কয়েক শ ব্যাটারিচালিত রিকশা।সরকার গত এক বছরে অন্তত দুইবার অটোরিকশা বন্ধের চেষ্টা করে। কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হয়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী মূলত সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা উঠতে বাধা কিংবা জব্দ করার পদক্ষেপ নেয়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হন চালকরা। কিন্তু যেখানে এসব ব্যাটারিচালিত রিকশা তৈরি করা হয়, সেই ওয়ার্কশপগুলোয় সরকারের নজরদারি নেই।
ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের সর্বশেষ উদ্যোগ ব্যর্থ হলে সরকার এখন বিভিন্ন ভিআইপি সড়কে এর চলাচল আটকানোর চেষ্টা করছে। রাজধানীর প্রধান প্রধান সড়ক ছাড়াও ফ্লাইওভারে পর্যন্ত অবৈধ বাহনটি যখন-তখন উঠে পড়ছে।গত বছরের ২১ নভেম্বর তিন দিনের মধ্যে ব্যাটারিচালিত রিকশার চলাচল বন্ধে উচ্চ আদালতের নির্দেশের প্রতিবাদে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করেন অবৈধ যানটির চালকরা।রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধ করা কঠিন : রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত রিকশার চলাচল বন্ধ করা সহজ হবে না বলে মনে করে ট্রাফিক পুলিশ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ট্রাফিক পুলিশ সদস্য জানান, সাধারণ মানুষ সহায়তা না করলে এসব রিকশা বন্ধ করা সহজ হবে না। যেকোনো সিগন্যালে দু-একজন ট্রাফিক পুলিশ সদস্য থাকেন, যাঁরা এসব অবৈধ রিকশা বন্ধ করতে চাইলেও সম্ভব নয়। অনেক সময় যাত্রীরাই ব্যাটারিচালিত রিকশার পক্ষে অবস্থান নেয়।
ডিএমপির মিডিয়া ও পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ব্যাটারিচালিত এসব রিকশার বিরুদ্ধে প্রতিবন্ধকতাসহ বিভিন্নভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আমরা ডাম্পিং করছি, জরিমানা করছি। তবু বন্ধ করা যাচ্ছে না।’সড়ক নিরাপদ করতে সমাধান কোন পথে : নগর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, ‘আপনি এখন বলছেন রাস্তায় আটকাবেন। কিন্তু আপনি যত রিকশা সরাবেন, তার চেয়ে বেশি জন্ম হচ্ছে। কারণ আপনার গ্যারেজের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। মোটর ব্যাটারি চীন থেকে এনে সংযোজন করা হচ্ছে। আমদানি বন্ধ না করলে ফল আসবে না।’তিনি আরো বলেন, ‘আবাসিক মিটারের অনুমতি নিয়ে অটোরিকশার চালকরা বাণিজ্যিকভাবে ব্যাটারিতে চার্জ করছে, সরকার কেন চার্জিং স্টেশন নিয়ন্ত্রণ করছে না। এই বিষয়গুলোর দিকে নজর দিলে কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।’
রিকশার নতুন নকশা করেছে বুয়েট : বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) যন্ত্রকৌশল বিভাগের একটি দল রিকশার একটি নকশা তৈরি করেছে। তারা বলছে, এই নকশার রিকশা হবে সাধারণ রিকশার চেয়ে নিরাপদ। অবশ্য এটি তৈরিতে বর্তমান ব্যাটারিচালিত রিকশার সমান খরচ পড়বে। এমন নকশা তৈরির পর ডিএনসিসি জানিয়েছে, তারা নতুন নকশার রিকশা ঢাকার রাস্তায় চলাচলের অনুমতি দেবে।নতুন রিকশার নকশা করেছে বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. এহসানের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের গবেষকদল। নকশা করা রিকশা মূলত রাস্তায় চলাচলকারী ইজি বাইকের মতো। দলের সদস্যরা জানান, এই রিকশায় ১৬টি বৈশিষ্ট্য যোগ করা হয়েছে। রিকশার দৈর্ঘ্য হবে ৩.২ মিটার, প্রস্থ দেড় মিটার এবং উচ্চতা ২.১ মিটার। সব মিলিয়ে আকার হবে এখনকার রিকশার মতোই। রিকশাটি সহজে ৩২৫ থেকে ৪২৫ কেজি পর্যন্ত ওজন বহন করতে পারবে। তিনটি চাকায় হাইড্রোলিক ডিস্ক ব্রেক ও বিকল্প পার্কিং ব্রেক থাকবে। সাধারণ রিকশায় লুকিং গ্লাস থাকে না। ফলে রিকশাচালককে পেছনে তাকিয়ে দেখতে হয় কোনো যান আসছে কি না।আবার সাধারণ রিকশায় ইন্ডিকেটর নেই। ফলে রিকশা ডানে অথবা বাঁয়ে মোড় নিলে পেছনের যানবাহনের চালকরা তা বুঝতে পারেন না, যা দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি করে। নতুন রিকশায় লুকিং গ্লাস ও ইন্ডিকেটর থাকবে।এ ছাড়া নতুন রিকশায় ছাউনি ও কাচের উইন্ডশিল্ড থাকবে। ফলে বৃষ্টিতে চালক ও যাত্রীদের ভিজতে হবে না। ব্যাটারি একবার চার্জ দিলে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূরত্ব যেতে পারবে নতুন রিকশা।ওয়ার্কশপ ও চার্জিং পয়েন্ট বন্ধে অভিযান : রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বন্ধে ওয়ার্কশপ ও চার্জিং পয়েন্ট বন্ধ করা হবে বলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ জানিয়েছেন।