অথচ ইসলাম যুগের পর যুগ ধরে যুবশক্তিকে আত্মনির্ভরশীল হতে প্রেরণা দিয়ে আসছে ।ইসলামের শিক্ষায় যুবসমাজ কেবল ভবিষ্যতের বাহক নয়, বরং বর্তমানের রূপান্তরকারী শক্তি। এ কারণেই বলা যায় যে, যুবশক্তি একটি জাতির হৃদস্পন্দন, যাদের সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ে ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে।
যৌবন হলো জীবনের এমন এক স্বর্ণালী অধ্যায়, যেখানে থাকে অপরিমেয় সাহস, উদ্যম আর সম্ভাবনার ঝলক। এ বয়সে মানুষের চিন্তাশক্তি থাকে শানিত, মনোবল থাকে দৃঢ়, আর স্বপ্ন থাকে বিস্তৃত।
“اللَّهُ الَّذِي خَلَقَكُم مِّن ضَعْفٍ ثُمَّ جَعَلَ مِن بَعْدِ ضَعْفٍ قُوَّةً ثُمَّ جَعَلَ مِن بَعْدِ قُوَّةٍ ضَعْفًا وَشَيْبَةً…”
‘আল্লাহই তোমাদের সৃষ্টি করেছেন দুর্বল (শৈশব) থেকে, তারপর দুর্বলতার পর দিয়েছেন শক্তি (যৌবন), এবং শক্তির পর দিয়েছেন দুর্বলতা ও বার্ধক্য।’ (সুরা: রূম, আয়াত: ৫৪)
এ আয়াতে যৌবনকে “শক্তি” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যা মানবজীবনের সবচেয়ে কার্যকর সময়।
মহানবী (সা.) বলেন:
“اغتنم خمسًا قبل خمس: حياتَك قبل موتِك، وصحتَك قبل سقمِك، وفراغَك قبل شغلِك، وشبابَك قبل هرمِك، وغناك قبل فقرِك”
‘পাঁচটি জিনিসকে পাঁচটি জিনিস আসার পূর্বে গুরুত্ব দাও: (১) মৃত্যুর আগে জীবন, (২) অসুস্থতার আগে স্বাস্থ্য, (৩) ব্যস্ততার আগে অবসর, (৪) বৃদ্ধ হওয়ার আগে যৌবন, (৫) দারিদ্র্যের আগে সম্পদ।
এই হাদীসের আলোকে এ কথা স্পষ্টতই বলা যায় যে, যৌবন এমন এক সময়, যার সৎ ব্যবহারে গড়া যায় এক উন্নত ভবিষ্যৎ; আর অপব্যবহারে সৃষ্টি হয় পতনের অনিবার্যতা।
আত্মনির্ভর যুবশক্তি তৈরিতে ইসলাম
মহানবী (সা.) মুসলিমদের কেবল ধর্মীয় দীক্ষাই দেননি, দিয়েছেন বাস্তব জীবনের শিক্ষা ও কর্মসংস্কৃতির দৃষ্টান্ত। তাঁর চাওয়া ছিল মুসলিম যুবক হবে আত্মমর্যাদাশীল, পরিশ্রমী এবং আত্মনির্ভর। তিনি বলেন-
“ مَنْ أَصَابَتْهُ فَاقَةٌ فَأَنْزَلَهَا بِالنَّاسِ لَمْ تُسَدَّ فَاقَتُهُ، وَمَنْ أَنْزَلَهَا بِاللهِ أَوْشَكَ اللهُ لَهُ بِالْغِنَى إِمَّا بِمَوْتٍ عَاجِلٍ أَوْ غِنًى عَاجِلٍ ”
‘যে ব্যক্তি দুর্ভিক্ষে পড়ে মানুষের দুয়ারে দুয়াতে চেয়ে বেড়ায়, তার ক্ষুধা কখনো বন্ধ হবে না। আর যে আল্লাহর স্মরণাপন্ন হয়েছে শিঘ্রই মহান আল্লাহ তাকে অমুখাপেক্ষী করবেন, হয়ত দ্রুত মৃত্যুর দ্বারা অথবা সম্পদশালী বানিয়ে।. (আবু দাউদ, হাদিস: ১৬৪৫)এই হাদিসের গভীরতম শিক্ষাই আজেকের আধুনিক স্কিল ডেভেলপমেন্টের আদর্শ। যেখানে আত্মনির্ভরতা, প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের সমন্বয়ে যুবকদের যোগ্যতম করে তোলার কথা বলা হচ্ছে।
একটি সমাজ যদি চায় তার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হোক দক্ষ, দূরদর্শী ও নেতৃত্বে পারদর্শী। তাহলে তাকে তিনটি ভিত্তির ওপর যুব উন্নয়ন গড়ে তুলতে হবে:
১. নৈতিকতা ও আদর্শ: সত্যবাদিতা, আমানতদারি, ইনসাফ, তাকওয়া ও পরিশ্রম এগুলো হচ্ছে ইসলামী চরিত্র গঠনের ভিত্তি।
২. কারিগরি ও পেশাগত শিক্ষা: রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগেও তরুণদের কৌশলগত শিক্ষায় উৎসাহ দেওয়া হতো— যেমন: কৃষি, ব্যবসা, চিকিৎসা, রণকৌশল, নৌযান পরিচালনা ইত্যাদি।
৩. সামাজিক ও নেতৃত্ব প্রশিক্ষণ: হজরত উসামা ইবনে যায়েদ (রা.) মাত্র ১৮ বছর বয়সে বিশাল বাহিনীর সেনাপতি নিযুক্ত হয়েছিলেন। যুবকদের উপর আস্থা রাখার এটি বড় দৃষ্টান্ত।
আজকের দিনের শিক্ষা
বিশ্ব যুব দক্ষতা দিবসে আমাদের মুসলিম সমাজের উচিত, নববী দৃষ্টিভঙ্গিতে নতুন করে ভেবে দেখা যে,
• আমাদের তরুণরা কতটা আত্মনির্ভর?
• তারা কী দক্ষতায় প্রস্তুত হচ্ছে আগামীর চাকরি ও কর্মক্ষেত্রে?
• তারা কি শুধু দুনিয়ামুখী হচ্ছে, না আখিরাতের জবাবদিহিতার কথাও ভাবছে?
যদি আমরা তরুণদের হাতে কেবল ডিগ্রি তুলে দিই কিন্তু চরিত্র গঠনে সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হই; তাহলে আমাদের জাতীয় ভবিষ্যৎ দুর্বল ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকবে। কাজেই প্রয়োজন যুবকদের জন্য এমন এক পূর্ণাঙ্গ প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা, যেখানে থাকবে প্রযুক্তির সঙ্গে আত্মিক শুদ্ধি, নেতৃত্বের সঙ্গে নম্রতা, আর দক্ষতার সঙ্গে থাকবে আল্লাহভীতি।যুবশক্তি যখন সঠিক দিকনির্দেশনা, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও নৈতিকতার আলোয় বিকশিত হয়; তখন একটি জাতি নিজের ভাগ্য নিজেই রচনা করতে পারে। ইসলাম এমন এক জীবনদর্শন দেয়, যা যুবকদের বানায় আত্মমর্যাদাশীল, দূরদর্শী এবং দুনিয়া ও আখিরাতের সফল পথযাত্রী।আজকের দিনটি হোক আমাদের যুবসমাজকে নতুনভাবে গড়ে তোলার প্রেরণা।যুবকদের হাতে কেবল মোবাইল নয়; তুলে দিতে হবে কুঠার, জ্ঞান, আস্থা, এবং দ্বীন ও দুনিয়ার সুষম শিক্ষার আলোকবর্তিকা।লেখক- শিক্ষার্থী, তাকমিল, জামিয়া ইমদাদিয়া দারুল উলুম মুসলিম বাজার, মিরপুর, ঢাকা।