وَ لَقَدْ كَرَّمْنَا بَنِيْۤ اٰدَمَ وَ حَمَلْنٰهُمْ فِي الْبَرِّ وَ الْبَحْرِ وَ رَزَقْنٰهُمْ مِّنَ الطَّيِّبٰتِ وَ فَضَّلْنٰهُمْ عَلٰي كَثِيْرٍ مِّمَّنْ خَلَقْنَا تَفْضِيْلًا.
আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি এবং স্থলে ও জলে তাদের জন্য বাহনের ব্যবস্থা করেছি, তাদেরকে উত্তম রিযিক দান করেছি এবং আমার বহু মাখলুকের ওপর তাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি। (সুরা বনী ইসরাঈল, আয়াত : ৭০)
মানুষের এই মর্যাদা শুধু ধর্ম, জাতি, শ্রেণি বা চিন্তার ভিত্তিতে সীমাবদ্ধ নয়। একজন সাধারণ মানুষ এমনকি একজন ভিন্নমতাবলম্বীও তার প্রাণের নিরাপত্তা পেতে আল্লাহর পক্ষ থেকে সম্মানিত।
﴿مَنْ قَتَلَ نَفْسًا بِغَيْرِ نَفْسٍ أَوْ فَسَادٍ فِي الْأَرْضِ، فَكَأَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِيعًا﴾
‘যে ব্যক্তি হত্যা করে একজনকে, বিনা ন্যায্য কারণে বা পৃথিবীতে ফাসাদের অপরাধ ছাড়া, সে যেন পুরো মানবজাতিকে হত্যা করল।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত : ৩২)
একটি প্রাণ হত্যা, সেটি যদি কোনো সাধারণ ব্যক্তি দ্বারাও ঘটে, বা সেটি যদি একটি উত্তেজিত জনতার মাধ্যমে সংঘটিত হয়—তবু তার শাস্তি ভয়াবহ। আল্লাহর বিধানে কাউকে হত্যা করার অনুমতি কেবল আদালত, শরিয়তের ন্যায়বিচার অনুযায়ী নির্ধারিত সীমানায়।
﴿وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ أَنْ يَقْتُلَ مُؤْمِنًا إِلَّا خَطَأً﴾
‘কোনো মুমিনের জন্য সম্ভব নয়, সে আরেক মুমিনকে হত্যা করবে; ভুলবশত হলে ভিন্ন কথা।’ (সুরা নিসা, আয়াত: ৯২)
অন্যত্র আরো কঠোর ভাষায় বলা হয়েছে—
﴿وَمَن يَقْتُلْ مُؤْمِنًا مُّتَعَمِّدًا فَجَزَاؤُهُ جَهَنَّمُ خَالِدًا فِيهَا…﴾
যে ব্যক্তি কোনো মুমিনকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করে, তার শাস্তি জাহান্নাম; সেখানে সে চিরকাল থাকবে…‘
(সুরা নিসা, আয়াত : ৯৩)
রাসূলের হুঁশিয়ারি: এক মুসলিমের রক্ত, সম্মান, সম্পদ হারাম
প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বিদায় হজে উম্মাহর প্রতি যে ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন, তাতে তিনি মুসলমানদের পরস্পরের জান, মাল ও ইয্যতের মর্যাদা ঘোষণা করেন:
فَإِنَّ دِمَاءَكُمْ وَأَمْوَالَكُمْ وَأَعْرَاضَكُمْ بَيْنَكُمْ حَرَامٌ…
তোমাদের রক্ত, সম্পদ ও সম্মান পরস্পরের ওপর হারাম, যেমন এই দিন, এই মাস, এই শহর (মক্কা) হারাম….।
(বুখারি, হাদিস: ৬৭)
মব সন্ত্রাসের নামে একজন নিরীহকে হত্যা করা যেমন হারাম, তেমনি তার সম্মান ভাঙচুর, গুজব ছড়ানো বা তার পরিবারকে নিপীড়ন করাও সেই হারামকেই বাস্তব রূপ দেওয়া।
হত্যা : এমন গুনাহ যার জন্য ক্ষমা নেই
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন—
«كُلُّ ذَنْبٍ عَسَى اللهُ أَنْ يَغْفِرَه، إِلّا مَنْ مَاتَ مُشْرِكًا، أَوْ مُؤْمِنٌ قَتَلَ مُؤْمِنًا مُتَعَمِّدًا»
‘সব গুনাহ আল্লাহ ক্ষমা করতে পারেন, তবে মুশরিক অবস্থায় মৃত্যু বা মুমিনকে ইচ্ছাকৃত হত্যা—এ দু’টি নয়।
“ يَجِيءُ الْمَقْتُولُ بِالْقَاتِلِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ نَاصِيَتُهُ وَرَأْسُهُ بِيَدِهِ وَأَوْدَاجُهُ تَشْخُبُ دَمًا يَقُولُ يَا رَبِّ هَذَا قَتَلَنِي حَتَّى يُدْنِيَهُ مِنَ الْعَرْشِ ”
‘মহানবী (সা.) বলেছেন, কিয়ামতের দিন নিহত ব্যক্তি নিজ হাতে তার হত্যাকারীকে তার কপালের চুল ও মাথা ধরে নিয়ে আসবে। তার ঘাড়ের কর্তিত রগসমূহ হতে রক্ত বের হতে থাকবে। সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! এ লোক আমাকে হত্যা করেছে। এমনকি সে তার হত্যাকারীকে নিয়ে আরশের নিকট পৌছে যাবে।’
(তিরমিযি, হাদিস: ৩০২৯)
গর্ভস্থ শিশু হত্যাও মব সন্ত্রাসের সমতুল্য
আজকের আধুনিক সমাজে গর্ভাবস্থায় কন্যাশিশু বা ‘অতিরিক্ত সন্তান’ বিবেচনায় ভ্রূণহত্যা এক নীরব হত্যাযজ্ঞে পরিণত হয়েছে। কোরআনে এর নিন্দা করে বলা হয়েছে—
﴿وَلَا تَقْتُلُوا أَوْلَادَكُمْ خَشْيَةَ إِمْلَاقٍ…﴾
‘দারিদ্র্যের আশঙ্কায় তোমরা সন্তান হত্যা করো না… তাদের হত্যা গুরুতর গুনাহ।’
(সুরা বনী ইসরাঈল, আয়াত :৩১)
কিয়ামতের দিন সেই হত্যাকৃত শিশুদের জিজ্ঞাসা করা হবে—
﴿بِأَيِّ ذَنبٍ قُتِلَتْ﴾
‘সে কোন অপরাধে হত্যা হয়েছিল?’
(সুরা তাকবীর, আয়াত : ৯)
মব সন্ত্রাস শুধু একটি মানবহত্যা নয়; এটি ঈমানের পতন, নৈতিকতার ধ্বংস, সমাজের ঘৃণ্যতম ব্যর্থতা। ইসলাম শান্তির ধর্ম, দয়া ও ন্যায়বিচারের ধর্ম। যারা ধর্মের নামে বা সামাজিক উত্তেজনার ঢেউয়ে ভেসে মবসন্ত্রাসে অংশ নেয়, তারা যেনো জেনে রাখে—কোরআন তাদের জন্য ঘোষনা করে রেখেছে ভয়াবহ হুঁশিয়ারি আর আখেরাতে অপেক্ষমাণ অগ্নিশিখা।