সমাজে সংঘটিত বহু বিশৃঙ্খলার মূলে মাদক। এটি যুবসমাজকে ধ্বংসের হাতিয়ার। মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য মদকে হারাম করেছেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা, নিশ্চয় মদ, জুয়া, প্রতিমা-বেদি ও ভাগ্যনির্ধারক তীরসমূহ তো নাপাক শয়তানের কর্ম।
সুতরাং তোমরা তা পরিহার কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও। শয়তান শুধু মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চার করতে চায়। আর (চায়) আল্লাহর স্মরণ ও সালাত থেকে তোমাদের বাধা দিতে। অতএব, তোমরা কি বিরত হবে না?’ (সুরা মায়েদা, আয়াত : ৯০-৯১)নবীজি (সা.) ও সাহাবিরা মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।
তিনি শুধু মাদকসেবীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণেই ক্ষ্যান্ত হননি বরং মাদকের উৎস বন্ধ করতে কাজ করেন এবং বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন, নিম্নে সেই পদক্ষেপগুলোর কয়েকটি তুলে ধরা হলো—
নৈতিক ও সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি : শুধু আইন প্রয়োগ বা শাস্তি নয়, নবীজি (সা.) মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে মুসলমানদের মধ্যে গভীর নৈতিক ও সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি মদকে শয়তানের কাজ, সব অনিষ্টের জননী এবং আল্লাহর স্মরণ থেকে বিরত রাখার মাধ্যম হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যেমনটা উল্লিখিত সুরা মায়েদার আয়াতেও রয়েছে।
মাদকের উৎপাদন ও ব্যবসায় সরাসরি নিষেধাজ্ঞা : মহানবী (সা.) মাদকের উৎপাদন, বিপণন থেকে শুরু করে সেবন পর্যন্ত প্রতিটি পদক্ষেপকে নিষিদ্ধ করেছেন।এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করেছেন। এমনকি এর ভয়াবহতা সম্পর্কে সতর্ক করতে তাদের অভিশাপ পর্যন্ত করেছেন। আনাস ইবনে মালিক (রা.) বলেন, মাদকের সঙ্গে সম্পৃক্ত দশ শ্রেণির লোককে রাসুলুল্লাহ (সা.) অভিসম্পাত করেছেন। এরা হলো—মদ তৈরিকারী, মদের ফরমায়েশকারী, মদ পানকারী, মদ বহনকারী, যার জন্য মদ বহন করা হয়, মদ পরিবেশনকারী, মদ বিক্রয়কারী, এর মূল্য ভোগকারী, মদ ক্রেতা এবং যার জন্য মদ ক্রয় করা হয়। (তিরমিজি, হাদিস : ১২৯৫)
মাদক বিক্রির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ হারাম ঘোষণা : নবীজি (সা.) মাদকদ্রব্য বিক্রির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ সম্পূর্ণ হারাম ঘোষণা করেছেন।
এটি মাদকের বাণিজ্যিক দিককে অকার্যকর করার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে মক্কা বিজয়ের বছর মক্কায় অবস্থানকালে বলতে শুনেছেন; আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসুল মদ, মৃত জন্তু, শূকর ও মূর্তি কেনা-বেচা হারাম করা দিয়েছেন। (বুখারি, হাদিস : ২২৩৬)এই নিষেধাজ্ঞা মদের সরবরাহ শৃঙ্খলকে ভেঙে দেওয়ার ক্ষেত্রে কার্যকরী পদক্ষেপ ছিল।
মাদকদ্রব্য ধ্বংস করার নির্দেশ : যখন মদের নিষেধাজ্ঞাসংক্রান্ত চূড়ান্ত আয়াত (সুরা মায়িদার ৯০-৯১ আয়াত) অবতীর্ণ হয়, তখন নবীজি (সা.) সাহাবিদের সব ধরনের মজুদকৃত মদ ধ্বংস করে ফেলার নির্দেশ দেন এবং তাঁরা তাই করেন। আনাস (রা.) বলেন, একদিন আমি আবু তালহার বাড়িতে লোকজনকে মদ পান করাচ্ছিলাম। সে সময় লোকেরা ফাযিখ মদ ব্যবহার করতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) এক ব্যক্তিকে আদেশ করলেন, যেন সে এই মর্মে ঘোষণা দেয়, সাবধান! মদ এখন থেকে হারাম করে দেওয়া হয়েছে। আবু তালহা (রা.) আমাকে বললেন, বাইরে যাও এবং সমস্ত মদ ঢেলে দাও। আমি বাইরে গেলাম এবং সমস্ত শরাব রাস্তায় ঢেলে দিলাম। আনাস (রা.) বলেন, সেদিন মদিনার অলিগলিতে মদের প্লাবন বয়ে গিয়েছিল। (বুখারি, হাদিস : ২৪৬৪)
এই ঘটনাটি মাদকের উৎস বন্ধে নবীজি (সা.)-এর দৃঢ়তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। উৎপাদন বা ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ না দিয়ে, বিদ্যমান সব মজুদ ধ্বংস করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
এককথায়, মাদকের উৎস বন্ধে নবীজি (সা.)-এর কর্মপন্থা ছিল একটি সামগ্রিক ও সমন্বিত পদ্ধতি। তিনি কেবল মাদক সেবনকে হারাম করেননি, বরং এর উৎপাদন, ব্যবসা এবং সংশ্লিষ্ট সব অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন। বিদ্যমান সব মাদকদ্রব্য ধ্বংস করার নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং নৈতিক ও ধর্মীয় আলোচনার মাধ্যমে এর প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করেছিলেন। নবীজি (সা.)-এর এই পদক্ষেপগুলোর সমন্বয় মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে কার্যকর ভূমিকা রেখেছিল। বর্তমান সময়েও মাদকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য এই পদক্ষেপগুলো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
এ ক্যাটাগরির আরো নিউজ..