মালয়েশিয়ার কুয়ালার বুকে গড়ে ওঠা এক নান্দনিক সৌন্দর্যের নাম ‘ক্রিস্টাল মসজিদ’। এই মসজিদ শুধু নামাজ আদায়ের স্থান নয়, বরং এটি আধুনিক ইসলামী স্থাপত্য, প্রযুক্তিনির্ভর ইবাদত, পর্যটন, সামাজিক সম্প্রীতি ও অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্যের এক অনন্য সম্মিলন। আধুনিক স্থাপত্যের আলোয় নির্মিত এই মসজিদ এখন মালয়েশিয়ার সবচেয়ে আইকনিক ধর্মীয় ও পর্যটনকেন্দ্রগুলোর একটি। ২০০৬ সালে নির্মাণকাজ শুরু হওয়া ক্রিস্টাল মসজিদটি ২০০৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়।
প্রায় ৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে নির্মিত এই মসজিদটির গঠনে ব্যবহৃত হয়েছে কাচ, কুয়ার্টজ ও ইস্পাত, যা একে অপার দীপ্তি ও স্বচ্ছতা এনে দিয়েছে। ৯টি বড় গম্বুজ, ৫১টি ছোট গম্বুজ এবং চারটি সুউচ্চ মিনার নিয়ে গঠিত এই মসজিদে ইসলামী, মোগল ও আধুনিক আর্কিটেকচারের দৃষ্টিনন্দন মিশ্রণ দেখা যায়। এটি নির্মিত হয়েছে ‘পুলাউ ওয়ান মান’ নামের কৃত্রিম দ্বীপে, যা তেরেঙ্গানু নদীর বুকজুড়ে অবস্থিত ‘ইসলামিক হেরিটেজ পার্ক’-এর একটি অংশ। নদীর ওপর স্থাপিত হওয়ায় দূর থেকে মসজিদটি পানিতে ভাসমান এক জাহাজের মতো দেখায়।
মসজিদটিতে একসঙ্গে প্রায় এক হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। বিশেষ দিবসগুলোতে বাইরে প্রাঙ্গণসহ তিন হাজারেরও বেশি মানুষ অংশ নিতে পারেন। মহিলা ও প্রতিবন্ধীদের জন্য রয়েছে পৃথক ব্যবস্থা, হুইলচেয়ার সুবিধা, ব্রেইল বোর্ড ও শিশুদের খেলার জায়গা। ক্রিস্টাল মসজিদ মালয়েশিয়ার প্রথম ‘স্মার্ট মসজিদ’ হিসেবে পরিচিত।
এতে রয়েছে উচ্চগতির ওয়াইফাই, ডিজিটাল কোরআন পাঠ, অনলাইন খুতবা সম্প্রচার ও ইসলামী প্রযুক্তিনির্ভর বিভিন্ন সেবা। আধুনিক মুসলিম প্রজন্মের উপযোগী করে এই মসজিদকে সাজানো হয়েছে, যাতে ইবাদতের সঙ্গে প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটে। প্রতিদিন হাজার হাজার স্থানীয় ও বিদেশি পর্যটক এই মসজিদ পরিদর্শন করেন। ‘ইসলামিক হেরিটেজ পার্ক’-এ বিশ্বের বিখ্যাত মসজিদগুলোর ২১টি ক্ষুদ্র প্রতিরূপ (Taj Mahal, Qutub Minar, Al-Haram ইত্যাদি) পর্যটকদের বাড়তি আকর্ষণ তৈরি করেছে। এখানে রয়েছে গাইড সার্ভিস, টিকিটিং, উপহার সামগ্রীর দোকান, হালাল রেস্টুরেন্ট, নৌকাভ্রমণ এবং শিশুদের পার্ক।
পুরো পর্যটন কমপ্ল্লেক্স বছরে কয়েক মিলিয়ন রিংগিত রাজস্ব আয় করে, যা স্থানীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। মসজিদে রমজান মাসে ইফতার বিতরণ, দুস্থদের চিকিৎসা ও খাদ্যসেবা, বিয়ে, ইসলামিক আলোচনাসভা এবং গোটং রায়ং (স্বেচ্ছাসেবী পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচি) পরিচালিত হয়। এখানে অমুসলিম দর্শনার্থীদের জন্য নির্ধারিত সময়ে নির্দিষ্ট অংশে প্রবেশের সুযোগ রয়েছে, যা ধর্মীয় সহনশীলতার নজির। মসজিদ ও পার্ক ঘিরে গড়ে উঠেছে বিশাল কর্মসংস্থানের সুযোগ : গাইড, দোকানদার, নৌচালক, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, হস্তশিল্প বিক্রেতা ইত্যাদি। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে আলাদা স্টল ও ইসলামী হস্তশিল্প বিক্রির সুযোগ। তেরেঙ্গানু নদীর ওপর নৌকাভ্রমণের সময় পর্যটকরা দূর থেকে মসজিদের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন। সন্ধ্যায় আলো-সাউন্ড শোতে মসজিদ জ্বলজ্বল করে ওঠে, যা দর্শনার্থীদের মোহিত করে।
মালয়েশিয়া সরকার এই মসজিদকে ইউনেসকোর ‘World Islamic Cultural Landmark’ হিসেবে মনোনয়নের প্রস্তুতি নিচ্ছে। পাশাপাশি ভবিষ্যতে এখানে ভার্চুয়াল ইসলামিক একাডেমি, অনলাইন কোরআন শিক্ষা ও আন্তর্জাতিক কোর্স চালুর পরিকল্পনাও রয়েছে। বিশ্বব্যাপী এর প্রশংসা থাকলেও বাণিজ্যিকীকরণের কারণে কিছু মহলে বেশ সমালোচনাও আছে, যেখানে মসজিদের ধর্মীয় পরিবেশের চেয়ে পর্যটনের গুরুত্ব বেশি পাচ্ছে। তবে স্থানীয় প্রশাসনের দাবি, এটি একটি সাংস্কৃতিক দূতাবাসরূপে কাজ করছে, যা আধুনিক ও ঐতিহ্যের সম্মিলন। ক্রিস্টাল মসজিদ একটি স্থাপত্য বিস্ময়, যা আধুনিক ইসলামী সভ্যতার প্রতীক। ধর্ম, প্রযুক্তি, সংস্কৃতি, শিক্ষা ও অর্থনীতির এক ছায়াতলে এই মসজিদ আজ শুধু মালয়েশিয়ার গর্ব নয়; বরং গোটা মুসলিম বিশ্বের জন্য এক যুগান্তকারী অনুপ্রেরণা।
এ ক্যাটাগরির আরো নিউজ..