ইতিহাস শুধু অতীতের স্মৃতি নয়, বরং একটি জাতির আত্মপরিচয়ের দর্পণ। আর ইসলামী ইতিহাস্ল—বিস্তৃত মহাসমুদ্র, যার প্রতিটি তরঙ্গে জড়িয়ে আছে ঈমান-আকিদা, ত্যাগ, সংগ্রাম ও বিজয়ের গৌরবগাথা। অথচ সত্যকে আড়াল করে এই গৌরবময় ইতিহাসকে বারবার বিকৃত করার অপচেষ্টা চালানো হয়েছে। কারণ ইসলামের শত্রুরা খুব ভালো করেই জানে, ইসলামী ইতিহাস শুধু স্মৃতিচারণা নয়, বরং তা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তোলার এক প্রভাবশালী হাতিয়ার।এই ইতিহাসই একটি জাতিকে আত্মমর্যাদা, ন্যায়বিচার ও আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা নিয়ে গড়ে ওঠার পথ দেখায়। তাই শত্রুরা ইতিহাস বিকৃত করে এমন এক শূন্যতা সৃষ্টি করতে চায়, যাতে আগামী প্রজন্ম দিশাহীন হয়ে পড়ে। তারা চায়, ইসলামী আদর্শ ও মন-মানসিকতা দুর্বল হোক, যেন ইতিহাস আর কখনো উম্মাহ গঠনের অনুপ্রেরণায় পরিণত না হতে পারে। ইতিহাস বিকৃতির এ খেলায় ইহুদি গোষ্ঠী বরাবরই অগ্রগামী।তারা ছলনা, প্রতারণা, মিথ্যাচার ও ছদ্মবেশের চরম প্রতিভূ। শুরু থেকেই তারা ইতিহাসকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে এসেছে, বিশেষ করে শিক্ষাব্যবস্থার পাঠ্যক্রমে। তারা ইতিহাসের পটভূমি এমনভাবে পরিবর্তন করেছে, যেন তা তাদের সুপরিকল্পিত উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সহায়ক হয়।তাদের কুখ্যাত দলিল ‘প্রোটোকলস অব দ্য এল্ডারস অব জায়ন (Protocols of the Elders of Zion)’-এ এ ধরনের ষড়যন্ত্রমূলক চিন্তার সুস্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়।প্রোটোকল ১৬-তে বলা হয়েছে :‘আমরা প্রচলিত সত্য ইতিহাসের পরিবর্তে ভবিষ্যতের সমস্যা নিয়ে পাঠদান চালু করব। প্রাচীন ইতিহাস পড়ানো হলেও এমন দৃষ্টান্তই তুলে ধরা হবে, যেখানে মন্দ উদাহরণ থাকবে বেশি। আমরা অতীতের মহান ব্যক্তিত্বদের স্মৃতি মুছে ফেলব, যা আমাদের পরিকল্পনার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে, এবং এমন কিছুই রাখব না যা শাসকদের ভুলকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে।’প্রোটোকল ১৪-এ বলা হয়েছে :‘মানব জীবনের প্রকৃত কল্যাণ ও সুখের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বিষয়গুলো বুঝতে না পারার কারণে, বহু শতাব্দী ধরে আন্তর্জাতিক সরকারগুলো যে ভয়াবহ ভুল করেছে আমরা সে ভুলগুলোর দিকেই বিশেষভাবে দৃষ্টি দেব।’এসব ঘৃণ্য নীতিমালা শুধু কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; বরং তা বাস্তবেও নানাভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছে।ইতিহাসকে বিকৃত করে, নির্বাচিত তথ্যকে আলাদা দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করে, পশ্চিমা চিন্তাধারাকে আরবি ভাষায় লিখে ইসলামী ভাবধারার নামে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিখ্যাত ফরাসি প্রাচ্যবিদ চার্লস বেলার একটি মন্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এক আরব সাংবাদিক তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনি কোন ধরনের আরবি সাহিত্য পড়েন প্রাচীন না আধুনিক?’ তিনি জবাব দেন, ‘শুধু প্রাচীন।’ সাংবাদিক আবার প্রশ্ন করেন, ‘আধুনিক সাহিত্য পড়েন না কেন?’উত্তরে তিনি বলেন, ‘কারণ তা আরবি হরফে লেখা হলেও মূলত পশ্চিমা চিন্তাধারার সাহিত্য।’
এই কথাগুলো নিছক ব্যক্তিগত নয়; বরং তা সচেতন দৃষ্টিভঙ্গির উত্কৃষ্ট উদাহরণ। আজকের তথাকথিত আধুনিক আরবি সাহিত্য, গবেষণা বা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার বড় অংশই পাশ্চাত্য চিন্তাধারার ছাঁচে গড়া। বাহ্যিকভাবে তা আরবি ভাষায় উপস্থাপিত হলেও তার অন্তর্নিহিত দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্লেষণধারা ইসলামী সভ্যতার নয় বরং পশ্চিমা মূল্যবোধেরই প্রতিফলন। অথচ ইসলামী সভ্যতা ও পাশ্চাত্য সভ্যতা—এই দুটি ভিন্ন দর্শন, ভিন্ন মূল্যবোধ ও ভিন্ন সংস্কৃতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং একটির মানদণ্ডে অন্যটিকে বিচার করার যে প্রবণতা, তা নিতান্তই বিকৃতি ও চরম বিভ্রান্তি।ইসলামী ইতিহাসে প্রতিটি উত্থান-পতনের পেছনে রয়েছে সুস্পষ্ট নৈতিক ও নীতিগত ব্যাখ্যা। যে কেউ এসব গভীর মনোযোগ, চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণার মাধ্যমে পর্যালোচনা করবে, সে স্পষ্টভাবে দেখতে পাবে ইতিহাসের জোয়ার-ভাটা, বিজয়-পরাজয়, সমৃদ্ধি-পতন, সচ্ছলতা-দারিদ্র্য কিংবা অগ্রগতি-পশ্চাৎপসরণ এসব কিছুই একটি মৌলিক বাস্তবতার সঙ্গে সম্পৃক্ত। আর তা হলো, জাতি ইসলামের সঙ্গে কতটা ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত কিংবা তা থেকে কতটা দূরে সরে গেছে। ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শের প্রতি আনুগত্যের পরিমাণ যত বেশি হয়েছে, উম্মাহ তত বেশি উন্নতি ও সম্মানের শিখরে পৌঁছেছে। পক্ষান্তরে যখনই এই সম্পর্ক দুর্বল হয়েছে, তখনই নেমে এসেছে বিভ্রান্তি, বিভাজন ও পতন।ইতিহাসের দিকে তাকালেই আমরা এর প্রমাণ দেখতে পাই খেলাফতে রাশেদার যুগে ইসলামী সমাজ যেমন ন্যায় ও স্থিতির প্রতীক ছিল, তেমনি সংস্কারবাদী খলিফা উমর ইবনে আব্দুল আজিজ, প্রজ্ঞাবান শাসক হারুন আল-রশিদ, বীর নায়ক নূরুদ্দীন জঙ্গি এবং মহান মুক্তিদাতা সালাহউদ্দিন আইউবি (রহ.)-এর যুগ সাক্ষ্য দেয় ধর্মনিষ্ঠ নেতৃত্বের মাধ্যমে কিভাবে উম্মাহ উন্নতির শিখরে পৌঁছেছিল। এই সময়গুলো আমাদের শেখায় ইসলামের প্রতি আনুগত্য, আত্মমর্যাদা, বিজয় ও স্থিতিশীলতা। আর যেখানে ধর্ম থেকে বিচ্যুতি ঘটেছে, সেখানেই দেখা দিয়েছে দুর্বলতা, বিভ্রান্তি ও অধঃপতন।(আলোচ্য নিবন্ধ ইসলামিক ওয়েবসাইট আলোকাহ ডটনেটে প্রকাশিত ড. ওমর বিন মুহাম্মদ ওমর আব্দুর রহমানের ইতিহাস বিষয়ক লেখার সংক্ষিপ্ত অনুবাদ)
এ ক্যাটাগরির আরো নিউজ..