ব্যক্তিত্বজনিত মানসিক সমস্যা (Personality Disorders) বলতে আমরা সাধারণত বড়দের বিষয়েই শুধু ভাবি। কিন্তু অনেক সময় এই সমস্যার প্রাথমিক লক্ষণগুলো শিশু বা কিশোর বয়সেই দেখা যায়। বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা এখনো খুব সীমিত। তবে শিশুদের এই ধরনের সমস্যা চিহ্নিত করা এবং সময়মতো সাহায্য করা খুবই জরুরি।
বর্তমানে আমাদের দেশে শিশুদের ওপর বাড়তে থাকা পড়াশোনার চাপ, পারিবারিক টানাপড়েন এবং প্রযুক্তির প্রভাব মিলিয়ে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে নানা সমস্যা দেখা যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে শিশুদের ব্যক্তিত্বজনিত মানসিক সমস্যা সম্পর্কে জানা ও সচেতন হওয়া অত্যন্ত দরকার।চলুন আজ এ বিষয় নিয়েই আলোচনা করা যাক।সন্তানদের সঙ্গে সুস্থ সম্পর্ক গড়ে তুলুনএটি এমন একটি মানসিক অবস্থার যেখানে একজন শিশুর চিন্তা, অনুভূতি এবং আচরণ তার বয়স অনুযায়ী স্বাভাবিক আচরণ থেকে অনেক আলাদা হয়ে যায় এবং এটি দীর্ঘ সময় ধরে চলে।
শিশুদের মধ্যে এই ধরনের সমস্যার কিছু সাধারণ লক্ষণ হতে পারে
– বারবার খারাপ বা আক্রমণাত্মক আচরণ
– অন্যদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে সমস্যা
– সহানুভূতি বা আবেগ প্রকাশে ঘাটতি
– সবকিছু নিয়ে বাড়তি শঙ্কা বা নিয়ম মেনে চলার চাপ
– মুডের হঠাৎ পরিবর্তন ও উত্তেজনা
যদিও চিকিৎসকরা সাধারণত ১৮ বছর বয়সের আগে পুরোপুরি ব্যক্তিত্ব সমস্যা নির্ণয় করেন না, তবে আগেভাগেই এই লক্ষণগুলো চিনে ফেলা গেলে অনেক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।
শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা
বাংলাদেশে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা এখনো যথেষ্ট উন্নত নয়। যদিও ডিপ্রেশন বা দুশ্চিন্তা নিয়ে কিছুটা সচেতনতা তৈরি হয়েছে, কিন্তু ব্যক্তিত্বজনিত সমস্যাগুলো এখনো অনেক সময় ‘দুষ্টুমি’, ‘শাসনের অভাব’ বা অনেক সময় ‘অলৌকিক কিছু’ বলে ভুল বোঝা হয়।
বাংলাদেশে যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে
অসচেতনতা : অনেক বাবা-মা বা শিক্ষক এই ধরনের সমস্যাকে মানসিক সমস্যা হিসেবে চিনতেই পারেন না।
সমাজে মানসিক রোগ নিয়ে ট্যাবু : শিশুর আচরণগত সমস্যা হলে অনেকেই লজ্জা পান বা লুকাতে চান।
বিশেষজ্ঞের অভাব : শিশুদের জন্য প্রশিক্ষিত মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ খুব কম।
সেবা পাওয়ার সমস্যা : গ্রাম বা শহরতলিতে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রায় নেই বললেই চলে।
পারিবারিক পরিবেশ : পারিবারিক ঝামেলা, বাবা-মায়ের মধ্যে অশান্তি, অবহেলা বা নির্যাতন শিশুর মনে গভীর প্রভাব ফেলে।
পড়াশোনার চাপ : অনেক সময় অভিভাবকরা শিশুদের ওপর বেশি পড়ার চাপ দেন, আর স্কুলগুলোতে শাস্তিমূলক পরিবেশে শিশুর আবেগ প্রকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।
নগরায়ন ও প্রযুক্তি : শহরের ব্যস্ততা ও মোবাইল-ইন্টারনেটের ব্যবহার শিশুদের মাঝে একাকীত্ব বাড়িয়ে দেয়।
দারিদ্র্য ও ট্রমা : দারিদ্র্য, শিশুশ্রম বা ঘরছাড়া হওয়া—এসব শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যকে বড়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
আগেভাগে সমস্যা চিনে নেওয়া কেন দরকার?
যত তাড়াতাড়ি এই ধরনের সমস্যা চিহ্নিত করা যায়, তত তাড়াতাড়ি সঠিক চিকিৎসা বা সহায়তা দেওয়া সম্ভব হয়। এতে ভবিষ্যতে বড় হয়ে কোনো জটিলতা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়।
উপযুক্ত চিকিৎসার কিছু উদাহরন
– আচরণগত থেরাপি
– পরিবারের কাউন্সেলিং
– স্কুলে মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা
– শিশু ও অভিভাবকদের সচেতনতা বাড়ানো
তবে বাংলাদেশে অনেক সময় শিশুর সমস্যা খুব গুরুতর হয়ে না উঠলে কেউ চিকিৎসকের কাছে যান না।
সমাধানের পথ কী হতে পারে?
সচেতনতা বৃদ্ধি : টিভি, রেডিও বা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে বাবা-মা, শিক্ষক ও সাধারণ মানুষকে এই বিষয়ে সচেতন করা।
স্কুলে মানসিক স্বাস্থ্য প্রোগ্রাম : প্রতিটি স্কুলে কাউন্সেলর রাখা দরকার, অন্তত উপজেলা পর্যায়ে হলেও।
বিশেষজ্ঞ তৈরি : দেশে আরও বেশি চাইল্ড সাইকোলজিস্ট, সাইকিয়াট্রিস্ট এবং স্যোশাল ওয়ার্কার তৈরি করতে হবে।
গবেষণা ও তথ্যভিত্তিক কাজ : আমাদের নিজস্ব বাস্তবতার উপর ভিত্তি করে মানসিক সমস্যার তথ্য সংগ্রহ ও গবেষণা বাড়াতে হবে।
সরকারি সহায়তা ও নীতি : সরকারের ২০১৮ সালের ‘মেন্টাল হেলথ অ্যাক্ট’-এর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিতে হবে।
শিশুদের ব্যক্তিত্বজনিত মানসিক সমস্যা নিয়ে এখনই সচেতন না হলে ভবিষ্যতে অনেক শিশুর জীবন বাধাগ্রস্ত হতে পারে। সমাজে এই সমস্যা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা, সহানুভূতি, এবং সঠিক চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তোলা খুব জরুরি। প্রতিটি শিশুই সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠার অধিকার রাখে—শুধু দরকার আমাদের একটু সচেতনতা আর সহানুভূতি।
তথ্যসূত্র :
১. বাংলাদেশ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য কৌশলপত্র (২০২০-২০৩০)
২. বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) মানসিক স্বাস্থ্য রিপোর্ট
৩. ঢাকা জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের শিশু-কিশোর মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগ