পারমাণবিক শক্তিধর দুই প্রতিবেশি ভারত-পাকিস্তান মধ্যে চার দিন ধরে চলমান সংঘাত আচমকাই বন্ধের ঘোষণা আসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। চলমান এই সংঘাতে এটা ছিল নাটকীয় মোড়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পারমাণবিক শক্তিধর এই দুই দেশকে বিপর্যয়ের মুখ থেকে ফিরিয়ে আনতে পর্দার আড়ালে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতাকারী, কূটনৈতিক ‘ব্যাকচ্যানেলে’র এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তবে যুদ্ধবিরতির ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা পরই দুই দেশ যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করে।মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষণার আগে এই সংঘাত একটি পূর্ণমাত্রার যুদ্ধের দিকেই আগাচ্ছিল বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। এর আগে ভারত-শাসিত কাশ্মীরের পহেলগামে এক প্রাণঘাতী হামলায় ২৬ জন পর্যটক নিহতের পর পাকিস্তান ও পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরে বিমান হামলা চালায় ভারত। এর ফলে টানা চারদিন ধরে আকাশপথে লড়াই ও তীব্র গোলাবর্ষণ চলতে থাকে। শনিবার সকালে উভয় পক্ষের বিমানঘাঁটিতেই ক্ষেপণাস্ত্র হামলার অভিযোগ উঠে।দুই দেশের পক্ষ থেকেই দাবি করা হয়, প্রতিপক্ষের বড় ক্ষতি করেছে এবং নিজের দেশে হওয়া হামলা প্রতিহত করেছে। ওয়াশিংটন ডিসি-র ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের সিনিয়র ফেলো তানভি মদান বলেন, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ৯ মে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে যে ফোন করেছিলেন তা ‘সম্ভবত একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ মোড় ছিল’।তিনি আরো বলেন, ‘আমরা এখনও জানি না আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পক্ষ ঠিক কী ভূমিকা পালন করেছে, তবে এটা স্পষ্ট যে গত তিন দিন ধরে অন্তত তিনটি দেশ – যুক্তরাষ্ট্র তো বটেই, তার সঙ্গে যুক্তরাজ্য ও সৌদি আরবও এই উত্তেজনা প্রশমনে কাজ করেছে।’পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার পাকিস্তানি গণমাধ্যমকে বলেন, এই কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় ‘তিন ডজন দেশ’ জড়িত ছিল— যাদের মধ্যে ছিল তুরস্ক, সৌদি আরব এবং যুক্তরাষ্ট্র।তানভি মদানের মতে, ‘প্রশ্ন হচ্ছে, যদি এই টেলিফোন কলটা আরও আগে – ভারতের প্রাথমিক হামলার ঠিক পর পরই আসত, যখন পাকিস্তান ইতোমধ্যে ভারতের ক্ষয়ক্ষতির দাবি করছিল এবং উত্তেজনা হ্রাসের সুযোগ ছিল, তাহলে হয়ত পরবর্তী সংঘর্ষ এড়ানো যেত।’এর আগেও ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাত নিরসনে কাজ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। নিজের আত্মজীবনীতে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও লিখেছেন, ২০১৯ সালের ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার সময় তাকে এক ভারতীয় কর্মকর্তার সাথে কথা বলার জন্য ঘুম থেকে জাগানো হয়েছিল। ওই কর্মকর্তা আশঙ্কা করেছিলেন, পাকিস্তান পারমাণবিক অস্ত্র প্রস্তুত করছে। তবে পাকিস্তানে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাই কমিশনার অজয় বিসারিয়া বলেছিলেন, পম্পেও পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা উভয়ই অতিরঞ্জিত করেছিলেন।তবে এবার সংকট নিরসনে যুক্তরাষ্ট্র যে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে সে বিষয়ে একেবারেই সন্দেহ নেই। অজয় বিসারিয়া বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাইরের শক্তি। আগের বার পম্পেও দাবি করেছিলেন তারা পারমাণবিক যুদ্ধ ঠেকিয়েছিলেন।তিনি বলেন, ‘এবারও তারা হয়ত নিজেদের ভূমিকা অতিরঞ্জিত করে দেখাবে। কিন্তু এটা ঠিক, এবারে সম্ভবত তারা মূল কূটনৈতিক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে এবং দিল্লির অবস্থানকে ইসলামাবাদে জোরেশোরে তুলে ধরেছে।’তবে সংঘাতের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্র বেশ নির্লিপ্ত ছিল। গত বৃহস্পতিবার উত্তেজনা যখন চরমে তখন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভান্স বলেন, এই যুদ্ধ ‘আমাদের মাথা ঘামানোর ব্যাপার নয়’, তাই যুক্তরাষ্ট্র এতে জড়াবে না।অন্যদিকে ট্রাম্প বলেন, ‘আমি দুই দেশের (ভারত ও পাকিস্তানের) নেতাদেরই খুব ভালো চিনি, এবং আমি চাই তারা নিজেরা সমস্যার সমাধান করুক … আমি চাই তারা থেমে যাক, এবং আশা করি তারা এখন থামবে।’প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ইজাজ হায়দায় বলেন, এই বারের ঘটনায় আগেরগুলোর থেকে একমাত্র পার্থক্য ছিল এই যে, শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র নিরপেক্ষ ছিল। তিনি বলেন, আমেরিকার ভূমিকা আগের মতোই ছিল, তবে এবার তারা শুরুতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেনি। তারা প্রথমে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছে এবং পরে হস্তক্ষেপ করেছে।পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকরা বলছেন, সংঘাত যখন চরমে পৌঁছায়, পাকিস্তান তখন ‘ডুয়েল সিগনাল’ বা দু’রকম বার্তা দিতে শুরু করে – একদিকে সামরিক প্রত্যাঘাত চলতে থাকে, অন্য দিকে তারা ‘ন্যাশনাল কমান্ড অথরিটির’ (এনসিএ) বৈঠক ডাকার কথাও ঘোষণা করে, যা স্পষ্টতই পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগেরও ইঙ্গিত দেয়। সংকটের ঠিক এই পর্যায়েই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও দৃশ্যপটে আসেন।কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস-এর সিনিয়র ফেলো অ্যাশলে জে টেলিস বলেন, ‘এখানে আমেরিকা ছিল অপরিহার্য। পররাষ্ট্রমন্ত্রী রুবিও-র প্রচেষ্টা ছাড়া এই পরিণতি কিছুতেই আসত না।’ তার পাশাপাশি ওয়াশিংটনের সঙ্গে দিল্লির ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও এই ফলাফলে আসতে সাহায্য করেছে।ভারতের কূটনীতিকদের মতে, এবার শান্তির লক্ষ্যে তিনটি পথে প্রচেষ্টা ছিল, যা অনেকটা ২০১৯ সালের পুলওয়ামা-বালাকোট ঘটনার সময়েও দেখা গিয়েছিল। এগুলো হল :