স্বাধীনতার পর দেশটি একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্রে পরিণত হয়, যেখানে রাজা রাষ্ট্রপ্রধান হলেও কার্যত ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতেই কেন্দ্রীভূত থাকে। স্বাধীনতার পর মালয়েশিয়া অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হয়। দেশজুড়ে চরম দারিদ্র্য, সম্পদের অসম বণ্টন এবং জাতিগত বৈষম্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীরা মালয়েশিয়ায় শাসনের সময় থেকেই বিপুলসংখ্যক চীনা ও ভারতীয় শ্রমিককে নিয়ে এসেছিল, যারা পরবর্তীকালে দেশটির অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান দখল করে নেয়।বিপরীতে ভূমির প্রকৃত মালিক মালয় জাতিগোষ্ঠী পিছিয়ে পড়ে তারা দারিদ্র্য, বঞ্চনা ও প্রান্তিকতার শিকার হয়, যদিও দেশের মোট জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশেরও বেশি ছিল মালয় মুসলমান আর চীনাদের সংখ্যা ছিল মাত্র ২৬ শতাংশের নিচে। এই সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের ফলে ১৯৬৯ সালে মালয়রা তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবিতে দেশব্যাপী ব্যাপক বিক্ষোভ ও আন্দোলনে অংশ নেয়। উত্তাল পরিস্থিতির মুখে সরকার ‘মালয় ক্ষমতায়ন নীতি’ নামে একটি নতুন নীতি গ্রহণ করে, যার মাধ্যমে মালয় জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে একাধিক আইন ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়।১৯২৫ সালের ১০ জুলাই, মাহাথির মোহাম্মদ মালয়েশিয়ার একটি মধ্যবিত্ত মালয় মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।তিনি চিকিৎসাবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং পরে মালয়েশিয়ার শাসক দল উমনো (UMNO)-তে যোগ দিয়ে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সূচনা করেন। ১৯৭০ সালে মাহাথির রচিত ‘The Malay Dilemma’ (মালয় সংকট) বইটি প্রকাশিত হলে তিনি দেশজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসেন। বইটিতে তিনি মালয় মুসলমানদের পিছিয়ে পড়া, দারিদ্র্য ও সামাজিক বৈষম্যের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেন, যা সে সময় জাতিগত উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে আরো তীব্র প্রতিধ্বনি তোলে। যদিও বইটি বিতর্কের কারণে নিষিদ্ধ হয়, তবু এই নিষেধাজ্ঞাই মাহাথিরের জনপ্রিয়তাকে বহুগুণে বাড়িয়ে রাজনৈতিক মঞ্চে আরো শক্তিশালী করে তোলে।এরপর তিনি মালয়েশিয়ার সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন এবং ধীরে ধীরে রাজনৈতিক উচ্চতায় পৌঁছেন।১৯৮১ সালে তিনি মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এর আগে তিনি শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন, যেখান থেকে দেশব্যাপী আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষানীতির সূচনা হয়। তাঁর নেতৃত্বেই মালয়েশিয়া প্রবেশ করে উন্নয়ন, শিল্পায়ন ও আধুনিকায়নের এক নতুন অধ্যায়ে।“এ ডক্টর ইন দ্য প্রাইম মিনিস্টার’স অফিস” বইটিতে মাহাথির মোহাম্মদ তাঁর শাসনামলে মালয়েশিয়ায় গৃহীত প্রশাসনিক নীতিমালা ও ব্যবস্থাপনার ভিত্তি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি লেখেন, ‘ভালো শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য সুশৃঙ্খল ও কার্যকর প্রশাসন অপরিহার্য। এর পাশাপাশি দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে। দুর্নীতি দমনের জন্য আপনি চাইলে কঠোর আইন প্রণয়ন করতে পারেন, তবে তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এমন একটি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলা, যেখানে প্রতিটি কাজের প্রক্রিয়া, নির্ধারিত সময়সীমা এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার দায়িত্ব স্পষ্টভাবে নির্ধারিত থাকবে। যদি কোনো কর্মকর্তা নির্ধারিত সময়ে নির্দিষ্ট কাজ সম্পন্ন না করেন, তবে ধরে নেওয়া হবে তিনি হয় অদক্ষ নতুবা দুর্নীতিগ্রস্ত। সে অনুযায়ী তাঁকে জবাবদিহির আওতায় আনা হবে এবং প্রয়োজনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’মাহাথির শুধু কঠোর প্রশাসনিক শৃঙ্খলা আরোপেই থেমে থাকেননি, বরং তিনি দেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের ভিত্তিও স্থাপন করেন। তাঁর মতে, টেকসই উন্নয়নের মূল ভিত্তিগুলোর মধ্যে ছিল—বিদেশি বিনিয়োগের পথে বাধা দূর করা, দেশীয় সম্পদের ওপর নির্ভরতা বৃদ্ধি করা, বহির্বিশ্বের ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা পরিহার করা, দেশের নাগরিকদের জন্য মানসম্পন্ন ও আধুনিক শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা ইত্যাদি।এসব উদ্যোগের মাধ্যমে মালয়েশিয়া শুধু প্রশাসনিকভাবে নয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকেও একটি স্বনির্ভর, আধুনিক ও প্রতিযোগিতামূলক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়।মুহাম্মদ সাদিক ইসমাইল তাঁর বই ‘The Malaysian Experience’-এ লিখেছেন, মাহাথির যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন তার প্রথম ও অন্যতম প্রধান ছিল উৎপাদন খাত এবং রপ্তানি খাতে উৎসাহ প্রদান। মাহাথির বিশ্বাস করতেন, একটি শক্তিশালী অর্থনীতি গড়ে তুলতে হলে নিজেদের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে হবে এবং বৈদেশিক বাজারে প্রতিযোগিতা করতে হবে। এ কারণে মালয়েশিয়া সরকার বিদেশি বিনিয়োগকারীদের এমন কোনো সুবিধা দিতে নারাজ ছিল, যা স্থানীয় শিল্পের ক্ষতিসাধন করতে পারে। অর্থাৎ বিদেশি প্রতিষ্ঠান যেন এমনভাবে বাজারে প্রবেশ না করে, যাতে দেশের নিজস্ব শিল্প-কারখানা টিকে থাকতে না পারে। এই পদক্ষেপগুলো মালয়েশিয়ার অর্থনীতিকে নতুন গতি দেয় এবং দেশটির উন্নয়নের ভিত আরো মজবুত করে তোলে। মাহাথিরের দূরদর্শী নেতৃত্বে মালয়েশিয়া ধীরে ধীরে একটি শিল্পভিত্তিক, রপ্তানিমুখী ও আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতিতে পরিণত হয়। একসময় যেখানে দেশের দারিদ্র্যের হার ছিল প্রায় ৭১ শতাংশ, তা কমে বর্তমানে মাত্র প্রায় ১ শতাংশে নেমে এসেছে। ডা. মাহাথির মোহাম্মদ বিশ্বব্যাংকের চাপ ও পরামর্শ উপেক্ষা করে নিজস্ব ও স্বনির্ভর পথ বেছে নেন এবং জনগণকে উন্নয়ন প্রকল্পে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৮০-এর দশকের শুরুর দিকে, দেশের মোট জনসংখ্যা ছিল প্রায় এক কোটি ২০ লাখ। এর মধ্যে প্রায় ৭০ লাখ মালয়েশিয়ান দেশের বড় বড় কম্পানিতে শেয়ার মালিক ছিলেন। ফলে তাঁরা শুধু বিনিয়োগকারী হিসেবেই নন, ব্যবস্থাপনায়ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। এই অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাকে আরো এগিয়ে নিতে মালয়েশিয়া সরকার দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের ওপর জোর দেয়। তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন কার্যক্রম ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়। এর ফলে মালয়েশিয়া বিশ্বে প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদের দিক থেকে ১৩তম এবং তেল মজুদের দিক থেকে ২২তম স্থানে উন্নীত হয়।শিক্ষাব্যবস্থা মালয়েশিয়ার অভিজ্ঞতার সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ একটি ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ডা. মাহাথির মোহাম্মদের অন্যতম প্রধান উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে অনুপ্রেরণা গ্রহণ করে তা মালয়েশিয়ায় বাস্তবায়ন করা।এই লক্ষ্যে তিনি জাপানে গবেষণা ও অনুসন্ধান মিশন পাঠান, যাতে মালয়েশিয়ার শিক্ষানীতিকে জাতীয় উন্নয়নের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত করা যায়। জাপানের অভিজ্ঞতা অনুসরণ করে তিনি এমন শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি তৈরি করেন, যা শুধু একাডেমিক জ্ঞান নয়, বরং শিল্প ও প্রযুক্তিভিত্তিক দক্ষতা অর্জন এবং সমাজের বাস্তব চাহিদা পূরণে সক্ষম, মানবসম্পদ তৈরিতে সহায়ক।তিনি এত বড় লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় বাজেটের প্রায় এক-চতুর্থাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ করেন, যা সত্যিই এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল।